হাতপাখার গ্রাম মটমালিয়াট

0

কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে মালিয়াট ও মটমালিয়াট গ্রামে বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই শতাধিক পরিবারের নানা বয়সের নারী পুরুষ প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাতপাখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটান।

নিত্য নতুন আবিষ্কারের যান্ত্রিক যুগে এসেও তালপাতার পাখার কদর একটুও কমেনি। তাই গ্রীস্মের উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তালপাতা ও বাঁশ দিয়ে পাখা তৈরির ধুম পড়ে যায় গ্রামে গ্রামে। কেউ তালপাতাগুলো পানি দিয়ে ভেজানোর কাজ করছেন, কেউ পাতা রোদে শুকাচ্ছেন। কেউ কেউ পাতা কেটে সাইজ করছেন। কেউবা বাঁশ চিড়ে শলাকা তৈরি করছেন। কেউ আবার সুতা ও বাঁশের শলাকায় রঙ লাগাচ্ছেন। এভাবেই কয়েকজনের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে হাত পাখা।

কথিত আছে, প্রায় ৯০ বছর আগে গ্রামের সুকচাঁদ শেখ প্রথম তালপাতা বা বাঁশ দিয়ে পাখা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। পরে তার বংশধরেরাও এই কাজ শেখেন।

হাতপাখা কারিগর ফরিদা খাতুন বলেন, ‘তাঁর বাবা সুকচাঁদ ৯০ বছর আগে প্রথম পাখা তৈরি করেন। তাঁর কাছ থেকে চাচা, ভাই, ভাতিজা শিখেছেন। এখন গ্রামের সবাই তৈরি করেন। ছেলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘তিনি ৪৫ বছর ধরে পাখা তৈরি করছেন। প্রতিটিতে ৮-১০ টাকার বাঁশ, তার, মোম, সুতা ও পাতা লাগে। পাইকারি ১২-১৪ ও খুচরা ২০-২৫ টাকায় বিক্রি হয়। সপ্তাহে ১২শ পর্যন্ত পাখা তৈরি করেন। মৌসুমে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা বিক্রি হয়।’

বর্তমানে প্রায় ২ শতাধিক পরিবার তালপাতার পাখা তৈরি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। গরমে হাতপাখার চাহিদা বাড়ায় গ্রামে নারী পুরুষ থেকে শুরু করে নানা বয়সীরা পাখা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। সংসারের কাজের পাশাপাশি পাখা ধোয়া ও সেলাইয়ের কাজ করেন গৃহবধূ আবেদা খাতুন। এতে দিনে তিনি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পান। অষ্টম শ্রেণির তামিম হোসেন জানায়, সে দিনে প্রায় ১০০ থেকে ১২০টি পাখায় তার বাঁধতে পারে। এতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়।

কারিগররা বলছেন, হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয় ফাল্গুন মাসে, চলে ভাদ্র-আশ্বিন পর্যন্ত। অন্য সময় তাঁরা কৃষি, ব্যবসাসহ অন্য কাজ করেন। কারিগর আব্দুল হান্নান বলেন, আগের তুলনায় পাখার দাম বেড়েছে। বেড়ে গেছে কাঁচামাল ও নিত্যপণ্যের দামও। প্রণোদনা ও কম সুদে ঋণ পেলে কাঁচামাল ও পণ্য সংরক্ষণ করে বেশি লাভবান হতেন তাঁরা।

তালপাতা, বাঁশ, সুতা আর জিআই তার ব্যবহার করে তৈরি হয় এই হাতপাখা। কেবল মটমালিয়াট গ্রাম থেকেই বছরে তৈরি হয় প্রায় ৪ কোটি টাকার ৩০ লাখ হাত পাখা। অনেকের কাছে এটি এখন হাতপাখার গ্রাম নামেই পরিচিত।

এক একটি পাখা তৈরিতে খরচ হয় ৬ থেকে ৮ টাকা। পাইকারি ১২ থেকে ১৪ টাকায় এবং খুচরা ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হয় এসব পাখা। এ পাখা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরেও বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি পরিবার ছয় মাসে অন্তত ১৫ হাজার করে পাখা তৈরি করে।

সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে এসব পৈতৃক পেশাকে আরো আধুনিক করে দেশের শিল্প খাতে ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে করেন কারিগররা।

মটমালিয়াট গ্রামের পাখা ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিতান কুমার মণ্ডল। তিনি বলেন, “হাতপাখা তৈরির কাজ করে পরিবারগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। জনপদের ঐতিহ্যও টিকিয়ে রেখেছে। উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার ও প্রসারে উপজেলা প্রশাসন উদ্যোক্তা অ্যাপস, ম্যাপস ও মেলার ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনে সহজ শর্তে তাঁদের ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।

হাতপাখা শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে কারিগরদের বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি এলাকাবাসীর।

সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here