একটি মেশিন দিয়ে শুরু, এখন ৬০০ কর্মীর গার্মেন্টস মালিক মিতু বেগম

0
উদ্যোক্তা মিতু বেগম

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার নুনিয়াগাড়ী গ্রামের পুত্রবধু মিতু বেগম। একজন সফল উদ্যোক্তা হবেন এমন স্বপ্নই ছিল তার। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপও দিয়েছেন তিনি। ২০০৯ সালে মাত্র একটি সেলাই মেশিন দিয়ে ঘরোয়াভাবে সেলাইয়ের কার্যক্রম শুরু করেন মিতু। এখন তিনি একটি গার্মেন্টসের মালিক, যেখানে কাজ করছেন ৬০০ নারী কর্মী। কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে এই অবস্থানে পৌঁছেছেন তিনি।

সংসারে টানাপোড়েনে মায়েদের শেখানো হাতের কাজকে সম্বল করে শাড়িতে পুঁতি বসানো, জরির কাজ, নকশিকাঁথা, পাঞ্জাবি, বেডশিট, ম্যাক্সি, স্কার্ট, স্কার্ফ, বিয়ের পোশাক, লেহেঙ্গা, বোরকা, পহেলা বৈশাখ ও পহেলা ফাগুনের পোশাক, বালিশের কভার, ডাইনিং সেটসহ ঘর সাজানোর আইটেম তৈরি করা শুরু করেন মিতু। সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছেন অন্যদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন।

২০০৯ সালে প্রথম একটি সেলাই মেশিন নিয়ে কাটিং ও সেলাই, হাতের কাজ, এপ্লিকের কাজ, নকশিকাঁথা, নকশি বেডশিট, বেডশিট, বুটিকের ড্রেস, চাদর, পর্দা, কুশন ও টেবিল ম্যাট তৈরি করে স্থানীয়ভাবে বাজারজাত করতেন। যখন যে কাজের অর্ডার পেতেন তখন সেই কাজ করতেন মিতু। দিন দিন বাড়তে থাকে কাজের পরিমাণ। সেই সাথে বাড়তে থাকে তার নারী শ্রমিকের সংখ্যা। এভাবেই কাজ এগিয়ে যেতে থাকে মিতুর ঘরোয়া মিনি কারখানার।

এরপর মিতু গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের আওতায় বিআরডিবি পলাশবাড়ী উপজেলা শাখার মাধ্যমে ৩০ দিনের এমব্রয়ডারি প্রশিক্ষণ নেন। পাশাপাশি নিজের কারখানার নারীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে তাদেরও পলাশবাড়ী বিআরডিবি অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের সুযোগ করে দেন।

মিতুর সৃজনশীলতা, ব্যবসায়িক বুদ্ধি, রুচিবোধ, গ্রাহকের চাহিদা এবং মানসিকতা বিবেচনা করে এবং আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে পণ্য তৈরি করে থাকেন। যে কারণে তার তৈরি পণ্যের মান বেশ ভালো। এ কারণে জেলা-উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা নিউ মার্কেট ও আড়ং থেকে একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে। তাদের অর্ডার অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে নারী শ্রমিক আরও বৃদ্ধি করতে হয়। বতর্মানে কারখানায় এবং বাড়িতে কাজ করছেন ৬০০ নারী শ্রমিক। মাসে ৫ থেকে ৭ হাজার পিসের কাপড়ের বিভিন্ন কাজের অর্ডার আসে।

তার কারখানায় কেউ বেডশিট, কুশনে এপ্লিকের কাজ করছেন, কেউবা শাড়ি, ওড়না, টি-শার্ট, পাঞ্জাবি, নকশিকাঁথা, সালোয়ার-কামিজের উপর বিভিন্ন নকশা দিয়ে সুই-সুতো, জরির কাজ করছেন। গ্রামের অনেক নারী কাপড় বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাজ করে জমা দিয়ে পারিশ্রমিক নিয়ে যান। এমন আরও ২০০ নারী কাজ করেন তার সঙ্গে।

সংসারের কাজ সেরে দুটি টাকা অতিরিক্ত আয়ের লক্ষ্যে বসে না থেকে অবসর সময়ে কাজগুলো করেন গ্রামীণ নারীরা। অতিরিক্ত কিছু আয়ও হয় তাদের। অনেকেই এখন স্বামীর বোঝা না হয়ে নিজের হাত খরচ মিটিয়ে স্বামীর হাতে মাসের শেষে কিংবা সপ্তাহে কিছু টাকা দিতে পারছেন। এতে করে সংসারেও সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

কারখানার নারী কর্মীরা জানান, তাদের সংসারে খুবই অভাব ছিল। কাজও তেমন একটা জানা ছিল না তাদের। মিতু আপার সঙ্গে পরিচয় হবার পর তিনি তাদের পলাশবাড়ী বিআরডিবি অফিসের এমব্রয়ডারিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর তার কারখানায় কাজ শুরু করেন। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। নিজেদের হাত খরচের পাশাপাশি এখন সংসারেও কিছু দিতে পারছেন। ছেলে-মেয়েদেরও লেখাপড়া শেখাতে পারছেন।

নিজের ভাগ্যবদলের পাশাপাশি গ্রামের আরো ৬০০ নারীর ভাগ্যবদলে কাজ করছেন মিতু বেগম। তিনি বলেন, ‘জীবনে কোন কিছুই সহজ পথে আসে না। প্রতিটি পথেই কাঁটা বিছানো থাকে। আর তা উপরে ফেলার সাহস যাদের আছে কেবল তারাই জয়ী হবেন। আজ আমি সফল হয়েছি। দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস, মার্কেট থেকে বড় বড় অর্ডার আসে আমার কাছে। তাদের চুক্তি মোতাবেক সঠিক সময়ে মানসম্মত পণ্য দিতে হয়। এভাবে কাজ করে প্রতিমাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ থাকে।’

কারখানা চালাতে মিতুকে সহযোগিতা করছেন তার চাচাতো বোন মুক্তা। তিনি বলেন, ‘আমি মিতু আপুর কারখানার যেসব নারী শ্রমিক বাড়িতে কাপড় নিয়ে গিয়ে কাজ করেন তাদের নাম রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ করি এবং কাপড়ের পরিমাণ লিখি। পাশাপাশি রিজেক্ট কাপড় বাছাই করি। অনেক নারী শ্রমিক আছেন যারা একটু ভুল করেছেন। আমি সেই ভুলগুলো ধরে তাদের থেকে কাজ করিয়ে নেই।’

পলাশবাড়ী উপজেলা বিআরডিবি কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান জানান, গাইবান্ধা সমন্বিত পল্লী দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পের ভিশন পণ্যভিত্তিক পল্লী গঠনের লক্ষ্যে এমব্রয়ডারি ট্রেডে একমাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে মিতু নিজ চেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সহযোগিতা করা হয়েছে। তার মতো অন্যরা চাইলে উপজেলা বিআরডিবির পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here