কুষ্টিয়ার কলাচাষী আনারুল ইসলাম। প্রায় ২০ বছর ধরে কলার আবাদ করেন। প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ বিঘা জমিতে চাঁপা কলার আবাদ হয়। সদর উপজেলার উজান গ্রাম ইউনিয়নের বৃত্তিপাড়া হাটে কলা নিয়ে আসা আনারুল ইসলাম বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় দূরত্বের কারণে তার লাভ কম হয়। কুষ্টিয়া থেকে সহজে কলা নিয়ে পরিবহনে যাওয়ার মতো তার সাধ্য নেই। দূরত্ব অনেক, ঝুঁকিও রয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে তিনিসহ কুষ্টিয়ার কলাচাষীরা আগের দিন কলা কেটে পরদিন খুব ভোরে নিজেরাই ট্রাকে করে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকায় কলা নিয়ে যেতে পারবেন এবং লাভও পাবেন বেশি।
শুধু আনারুল ইসলাম একা নন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে তার মতো চাষীরা নতুন স্বপ্ন বুনছেন। ভাগ্য পরিবর্তনের অপেক্ষায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে ছোট-বড় কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা। পচনশীল কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে হাতে তৈরি পণ্য সহজে রাজধানীসহ সারাদেশে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে বলে তারা নতুন সম্ভাবনার জন্য অপেক্ষায় আছেন।
কলাচাষীদের মতো কুষ্টিয়ার পানচাষীরাও অপেক্ষায় রয়েছেন। ভেঁড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ঠাকুর দৌলতপুর এলাকার পান চাষী আব্দুর রহমান বলেন, ‘‘আমি দীর্ঘদিন ধরেই পান চাষ করি। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কুষ্টিয়ার মিরপুরে হাটে বসে পান পাইকারী দরে বিক্রি করতে হয়। এতে খুব একটা লাভ হয় না। পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামে পান নিয়ে যেতে পারলে অনেক বেশি লাভ হতো ,কিন্তু রাজবাড়ী দৌলতদিয়া, যমুনা সেতু পার হয়ে পান নিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৌঁছে তা বিক্রি করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এখন পদ্মা সেতুতে দিয়ে সেটা সম্ভব হবে।”
কুষ্টিয়া কৃষি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক বিষ্ণু পদ সাহা বলেন, ‘‘মধুপুর কলার হাটে প্রচুর কলার আমদানি হয়, তবে ফড়িয়াদের কারণে তারা ভালো দাম পান না। যোগাযোগের কারণে নিজেরা কলা রাজধানীতে নিয়ে যেতে পারেন না, ফলে হাটে বসেই কলা পাইকারীতে বিক্রি করতে হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে কুষ্টিয়ার কলাচাষীরা রাজধানী-ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যেতে পারবেন এবং লাভবানও হবেন।”
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান: অর্থকারী ফসলের মধ্যে পান একটি লাভজনক ফসল। কুষ্টিয়ার পান সারা দেশের মধ্যে বিখ্যাত ছিল। গত কয়েক বছর পানের বিভিন্ন রোগের কারণে পানচাষীদের লোকসান হয়। অপরদিকে পরিবহন খাতে ব্যয় বেশি হওয়ায় তারা ভালো লাভ পান না। পদ্মা সেতু চালু হলে এখান থেকে সরাসরি ঢাকা-চট্রগ্রামে চাষী ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ে কম খরচে পান নিয়ে যেতে পারবেন। এতে কৃষক ও পাইকারী ব্যবসায়ী সকলেই লাভবান হবেন। কুষ্টিয়ার কৃষি অর্থনীতিতে এর একটা সুফল পড়বে।
এমনিভাবেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে কুষ্টিয়ার সবজি, গরু, ছাগল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ায় খরচ কমবে, লাভ বেশি হবে। অর্থনীতিতে এর একটা সুফল পড়বে।
আলাদিনের চেরাগের অপেক্ষায় শরীয়তপুর
পদ্মা সেতু শুধু ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের মেলবন্ধনই তৈরি করে দেয়নি, উন্মুক্ত করে দিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সম্ভাবনাকেও। পদ্মা সেতুর কারণে শরীয়তপুরের আবাসন খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
শরীয়তপুরের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সময়সাপেক্ষ হওয়ায় অনেক সামর্থবান ব্যবসায়ীসহ উচ্চপদে চাকরিজীবীরা শরীয়তপুরে বসবাস করতে অনাগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সেতুর বদৌলতে এখন নিজ এলাকায় স্থায়ী বসবাসের প্রত্যয়ে নির্মাণ করতে শুরু করেছেন বাড়ি। ফলে নির্মাণ সামগ্রী বিক্রি এখন দ্বিগুণেরও বেশি।
ব্যবসায়ীরা আগামীর সোনালী স্বপ্ন দেখায় তৈরি হচ্ছে নতুন-নতুন শপিংমল, মার্কেট ও স্বতন্ত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর এ মহাযজ্ঞের হাত ধরে ব্যাপক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবন-মানেরও ব্যাপক উন্ননের স্বপ্ন বুনছেন জেলার ব্যবসায়ীরা।
শরীয়তপুর সদরের পালং বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম বেপারী বলেন, ‘‘পদ্মা সেতুকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছেন। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসার সম্প্রসারণসহ আগের ব্যবসায় তারা বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে শুরু করেছেন। রাস্তা-ঘাট সম্পসারণ ও নতুন-নতুন পাকা স্থাপনা গড়ে উঠতে শুরু করায় রড-সিমেন্ট, টাইলস, হার্ডওয়্যাার, কাঠের আসবাবপত্রসহ নানা ব্যবসা এখন নতুন গতি পেয়েছে।”
বাংলাদেশ রেঁস্তোরা ব্যবসায়ী মালিক সমিতি শরীয়তপুরের নেতা সোহাগ মোল্লা বলেন: পদ্মা সেতু আমাদের শরীয়তপুরবাসীর জন্য উন্নয়নের আলাদিনের চেরাগ বলা যায়। এখন শুধু সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ঘঁষা দেয়া। শরীয়তপুর পদ্মা মেঘনা বেষ্টিত জেলা হওয়ায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ কেবলই সময়ের ব্যাপার।
মিরাশার চাষীবাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. আব্দুল জলিল মাদবর বলেন, ‘‘কৃষি সমৃদ্ধ আমাদের জেলার কৃষকরা অনেক সময়ই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতেন না। ফলে যেভাবে বাণিজ্যিক কৃষির দিকে কৃষকদের অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল তা কিছুটা স্তিমিত ছিল, পদ্মা সেতুর ফলে তা পুনর্জীবন পাবে।”
এফবিসিসিআই এর ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য মো. নাসির উদ্দিন বাদল বলেন: আমাদের জেলা শরীয়তপুরে ইতিপূর্বে তেমন কোন পর্যটন ভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠেনি। জেলা ক্যাটাগরিতে শরীয়তপুর ৬৪ নম্বর জেলা হওয়ায় আমরা সার্বিক উন্নয়নে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে সক্ষম হইনি। তবে পদ্মা সেতুকে ঘিরে পর্যটনসহ বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রিক অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
শরীয়তপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি একেএম ইসমাইল হক বলেন, ‘‘পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে শরীয়তপুরে শুরু হবে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ। পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে থ্রি-স্টার মানের হোটেল-মোটেল তৈরি হবে। এছাড়া গড়ে উঠবে গার্মেন্টস, মাঝারি শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্প। উন্নয়ন সাধিত হবে মৎস্য, গবাদিপশু ও কৃষি খাতের। বিস্তৃত হবে সাধারণ ব্যবসার পরিসর, বাড়বে বিনিয়োগ। যা শুধু এই অঞ্চলের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করবে ,না ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে।”
উন্নয়ন স্বপ্নে বিভোর নড়াইল
নড়াইলবাসীও মনে করছেন পদ্মা সেতুর বদৌলতে তাদের জীবনে বড় পরিবর্তন আসবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খান বলেন: পদ্মা সেতু চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার যেমন উন্নত হবে, তেমনি এ এলাকার মানুষের জীবন মান উন্নত হবে। জেলায় উৎপাদিত মাছ, ধান-পাটসহ কৃষি পণ্য সহজে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করা যাবে। এতে কৃষক তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘পদ্মা সেতুর কারণে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবাহ জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে, মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। এ অঞ্চলে শিল্পায়নের দ্বার উন্মোচন হবে, এতে করে বেকার সমস্যার সমাধান হবে, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান।”
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন সিকদার বলেন: পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার সেতু। এটি চালু হলে নড়াইলসহ বিভিন্ন জেলার মানুষের রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার্থীদের সুবিধা হবে।
পদ্মা সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমত আরা বলেন, ‘‘নড়াইলসহ এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের চাওয়া পুরণ হতে চলেছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হবে। রাজধানীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন হবে। স্বল্প সময়ে আমরা ঢাকায় যেতে পারব, কাজ-কর্ম সেরে বিকেলের মধ্যে আবার ফিরে আসতে পারব। এতে করে আমাদের সময় অর্থ সাশ্রয় হবে।”
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন খান নিলু বলেন: স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে নড়াইলসহ দক্ষিণ-পঞ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। এর ফলে এ জেলায় মিল কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্ঠিত হবে, বেকারত্ব কমবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস বলেন, ‘‘পদ্মা সেতু চালু হলে নড়াইলসহ এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে যোগাযোগ ও অর্থনৈতকভাবে আমরা আরও বেশি শক্তিশালী হতে পারব।”
নড়াইল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হাসানুজ্জামান বলেন:পদ্মা সেতু চালু হলে নড়াইলের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। জেলায় ইতিমধ্যে বিসিক শিল্পনগরী এবং অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার প্রকল্প চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বড় বড় কোম্পান্নিগুলো নড়াইলে জমি ক্রয় করে মিল কলকারখানা তৈরী করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে করে আমাদের এ অঞ্চলের বেকার সমস্যার সমাধান করে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিপাবে। দেশের অন্যতম স্থলবন্দর বেনাপোল থেকেও আমদানি-রপ্তানি বাড়বে।
ডেস্ক রিপোর্ট,
উদ্যোক্তা বার্তা