সময়টা ২০০৮ সাল, নিপার এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র দুই মাস বাকি। সেই সময়ে শারীরিকভাবে একটি বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনা শেষ করে ভাল একটা চাকরি করবেন। কিন্তু হঠাৎই একদিন পরিবারের সিদ্ধান্তে নিপাকে বাধ্য হয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো। বিয়ের পর শশুর বাড়ি থেকে পড়াশোনা বন্ধের চাপ আসতে থাকে। পরবর্তীতে নিপা তার জীবনসঙ্গীকে বুঝিয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পান।
একটা কথা নিপা ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলেন, বরের স্বপ্নগুলো পূরণ এবং সংসার ছাড়া তার জীবনে আর কিছু থাকা যাবে না। নিজের জন্য কিছু করা মানেই সংসারে অশান্তি হবার আশঙ্কা। এভাবে সংসার জীবনের চার বছর কষ্ট করে পার করেন। এই সময়টাতে নিপার বরের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। এক সময় বরের চাকরিতে পদোন্নতি হয়। নিপা ভাবছিলেন এই বুঝি সংসারে আর্থিক টানাপোড়েনটা শেষ হলো।
কিন্তু না, অর্থই সকল অনর্থের মূল হলো। তার চলাফেরা-আচরণে বদল ঘটতে থাকে। তার এই পরিবর্তনের কারণে নিপাকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে হয়। পরিবারের সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেও স্বামীকে খুশি করতে পারেননি। কারণ তার জীবনে অন্য নারীর আগমনে নিপার সংসার জীবনে অশনি সংকেতের ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। নিপার মিথ্যা চাকরির বদলি হওয়ার নাটক সাজিয়ে বের করে দেয়া হয় স্বপ্নের সাজানো সংসার থেকে।
পরবর্তীতে উদ্যোক্তা বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাবার বাড়ি চলে যান। সাজানো সংসার ছেড়ে চলে আসার আগে উদ্যোক্তা কিছু রং কিনেছিলেন এবং ৩টি শাড়ি কিনেছিলেন। একটা নিজের জন্য, একটি শ্বাশুড়ি ও নিজের মাকে ডিজাইন করে দেয়ার জন্য। নিপা ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করতে ভালবাসতেন। মাঝে মাজে নিজের পোশাকে ডিজাইন করতেন।
উদ্যোক্তা সব কিছু ভুলে ভালোলাগার আঁকাআঁকিকে বাণিজ্যিক রূপ দিলেন। কাজে মনোনিবেশ শুরু করলেন। তার কাজগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায়, নিপার চারপাশের লোকেরা কাজের প্রশংসা করলে নিপা উৎসাহ পেতে থাকেন।
এভাবে উদ্যোক্তা নিপা তার ব্যবসার শুরুর দিকটার কথা বলতে গিয়ে স্মৃতি চারণ করে বলেন, একটু একটু করে যেন বেঁচে থাকার আগ্রহটা বাড়তে থাকে। আর বন্ধুরাও উৎসাহ দেয় এটা নিয়ে আগাতে। ব্যবসায় আমি তখন একেবারে শিশু। প্ৰশংসাটা আমাকে বেশি উৎসাহিত করতো। এক দিন কাছের এক বন্ধু অনুরোধ করে তার পাঞ্জাবিতে কিছু এঁকে দিতে পহেলা বৈশাখে পড়বে বলে। ভয়ে ভয়ে কাজটা করি। কিন্তু সেই কাজটাও অনেকের ভাল লাগে। বন্ধু তখন বলে তুমি পাঞ্জাবিটা নিয়ে কাজ করো। এর পর আমি শুরু করলাম কিছু পাঞ্জাবির কাজ। সেটা অল্প সময়ে বিক্রি হয়ে গেল। এভাবে বছরখানেক পার হয়ে গেলে আমার বিক্রি বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে আমার ব্যবসার সুনাম ছড়াতে লাগলো।”
উদ্যোক্তা নিপার কাছ থেকে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যবসা শুরু করছে। উদ্যোক্তা তার হারানো সব কিছু ভুলে নতুন উদ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন কাজই উদ্যোক্তার জীবনের মূলমন্ত্র। আগে নিপাকে অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হতে হতো এখন সবাই তাকে নিজ পরিচয়েই চেনে।
উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমি যতবার হেরে গেছি, ততবার আমার মনের ভেতরে স্মরণ হতো বেগম রোকেয়ার কথা নারীদের সামনে আগাতে তার চেষ্ট আমার নতুন করে শক্তি যুগিয়েছে’।
পরিশেষে উদ্যোক্তা তার স্বপ্ন পূরণ নিয়ে বলেন, ‘আজকে আমার নিজের কাজের জন্য নিজের একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে। দশজনের মধ্যে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছি। আমি আমার জীবনযুদ্ধে অনেকটাই সফল। তবে সফলতার কোনো শেষ নেই। তাই আমি আরো ভালো কিছু করার স্বপ্নে হাটছি। এক দিন ‘নিপা ক্রিয়েশন’ বড় একটা ব্র্যান্ড হবে এটাই আমার স্বপ্ন’।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা