একটা সময় ছিল বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে সোনার গয়নাই একমাত্র প্রচলন। যে বা যারা আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসতেন তাদের গায়েও ঝুলত জড়োয়ার নেকলেস, সোনার ঝুমকো। আর এখন কনের গায়ের গয়নাটাও সোনা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে উচ্চবিত্ত শ্রেণি। মধ্যবিত্তরাও সেই পথই অনুসরণ করতে শুরু করে দিয়েছেন। কুন্দন, ঝুমকা, নেকলেস, বালা, চুর, সীতা হারের দিন ফুরিয়ে এলো বলে। কারণ এখন দামি গয়না মানে শুধুই সোনার গয়না নয়। কাঠ, চামড়া, পশুর হাড়, শিং দিয়ে তৈরি গহনা আর ধাতুর মধ্যে রুপো তো বটেই তাছাড়া দস্তা, তামা, টাংস্টেনের মত নানান ধাতুর গয়না দিয়েই বিয়ের কনেকে সাজানো হচ্ছে।
কনসেপচুয়াল গয়নার যুগ এখন। উদ্যোক্তা এনা আহলুওয়ালিয়া (Eina Ahluwalia)। কলকাতার এই গয়না শিল্পীর হাত ধরে এই শহরেও কনসেপচুয়্যাল জুয়েলারি এখন ‘ইন থিং’। পুরানো ডিজাইনকে ফিরিয়ে এনে কখনও ব্যবহার হয়নি এমন সব ধাতু দিয়ে গয়নার নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টি করেছেন উদ্যোক্তা এনা।
এনার ডিজাইন মানেই তাঁর আবেগের প্রতিফলন, ভাবনা, শিল্পসত্ত্বার প্রকাশ। জীবনকে যেভাবে দেখতে চান সেই ভাবনা থেকে গয়না ডিজাইন করেন। কোনও বাঁধাধরা মাধ্যম নেই।
উদ্যোক্তা বলেন, ‘একটা সময় গয়নার খদ্দের ছিলেন পুরুষেরা। পরিবারের বাবা অথবা স্বামী। আর এখন মহিলারা নিজেদের গয়না নিজেরাই কেনেন। কোনও উপলক্ষের দরকার পড়ে না। শুধু সোনার গয়না কিনছেন তা কিন্তু নয়, দামি অথচ অন্য ধাতুর গয়না হামেশাই কিনছেন’।
এর কারণ হিসেবে শিল্পীর যুক্তি, মহিলারা নিজেরাই এখন রোজগার করেন। নিজেদের জন্য খরচ করতে সক্ষম। এক প্রজন্ম আগেও এভাবে ভাবতে পারতেন না মহিলারা। নিজেকে দেশের প্রথম কনসেপচুয়াল জুয়েলারি আর্টিস্ট বলেন এনা আহলুওয়ালিয়া। ডাচ ডিজাইনারদের কাজ দেখে প্রথম উদ্বুদ্ধ হন তিনি। ফ্লোরেন্সের অ্যালকিমিয়া কনটেম্পোরারি জুয়েলারি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ২০১০ সালে হল্যান্ডের বিখ্যাত কনসেপচুয়াল জুয়েলারি আর্টিস্ট রুড পিটার্সের কাছে তালিম নিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলে সমাদৃত হয়েছে শিল্পীর কাজ। চিরাচরিত ধারা থেকে অন্য রকম, তাই ফ্যাশন দুনিয়া ওকে চিনে নিতে সময় নেয়নি। ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে প্রতি বছর তার ব্র্যান্ড অংশগ্রহণ করে। ব্রিটিশ ভগ, সিআর ফ্যাশন বুক, ইনস্টাইল ইউকে, হার ওয়ার্ল্ড সিঙ্গাপুরের মতো ম্যাগাজিনে নিয়মিত চর্চার বিষয় উদ্যোক্তা এনার স্টাইল স্টেটমেন্ট।
২০০৩ সালে যখন গয়না তৈরি শুরু করেন তখন ক্রেতাদের মনের ইচ্ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতেন। বোঝার চেষ্টা করতেন ক্রেতার ঠিক কী চান? একটু অন্যরকম গয়না বানিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলেন। দেখলেন সাধারণভাবে যেসব গয়নায় তারা অভ্যস্ত তার থেকে অন্য কিছু পেয়ে সেই ক্রেতারাই দারুণ উত্তেজিত। এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে একবার কংক্রিটের কালেকশন নিয়ে এসেছিলেন। তেমন চলেনি। ঠেকে ঠেকে শিখেছেন ক্রেতার মর্জি। এর পর রূপোর গয়না, সোনার জল করা গয়না ডিজাইনে মন দেন। হিট হয়ে গেল আইডিয়া। আলুহওয়ালিয়া তার কাজের মধ্যেই আর্ট, ডিজাইন, ফ্যাশন সোশ্যাল অ্যাকটিভিজমকে মিশিয়ে ফেলেছেন।
উদ্যোক্তা এনা মেধাবী গয়না তৈরি করছেন। যে গয়না শুধু পরার জন্যে পরা নয়, যে গয়না আপনার মন, মেধা আর সামাজিক অবস্থানটাকে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে।
আর এটাকেই উদ্যোক্তা বলছেন, ‘ভারতীয় ঐতিহ্যের গয়নার সঙ্গে দেশাত্মবোধের মিশেল’। ধরা যাক ২০১১ সালে এনার নিয়ে আসা বিয়ের কালেকশনটি। ‘লাভ, রেসপেক্ট, প্রটেক্ট’ বলছিলেন কালেকশনটিকে। ঘরোয়া হিংসার বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ। গয়না ডিজাইনের মাধ্যমে সেই প্রতিবাদের ভাষাটাই প্রকাশ করেছিলেন তিনি। নেকলেস থেকে শুরু করে অন্যান্য গয়নায় ব্যবহার করেছিলেন কৃপাণ, ছোট্ট তলোয়ার, যাকে শিখ সম্প্রদায়ের একটি অন্যতম প্রতীক বলা হয়। এনার আরেকটি কালেকশন হল ‘অ্যাক্সেসরিজ দ্য ওয়ারিয়র উইদিন’। নামের মধ্যেই নিহীত স্লোগান। ওয়েস্টার্ন গয়নার প্রতি নতুন প্রজন্ম ঝুঁকলেও এনা তার ডিজাইনে ধরে রেখেছেন পুরানো ঐতিহ্য এবং ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণাকে।
‘ওয়ার্ডস্মিথ’ কালেকশনের ডিজাইনে শিল্পী ব্যবহার করেছেন ঈশ্বরের নাম উর্দু, আরবি ও হিন্দিতে। বলছিলেন উনি শুধু গয়না বিক্রি করেন না, তার ডিজাইনের মাধ্যমে একটা মেসেজ দিতে চান। শরীরে সেঁটে থাকা গয়নাই ওই বার্তার মাহাত্ম্য বুঝতে সাহায্য করে।
স্ট্র্যাটেজিক মার্কেট রিসার্চ ইউরোমনিটরের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় দ্বিগুণ হারে কস্টিউম জুয়েলারির চাহিদা বাড়ছে। তার কারণ হালকা অথচ স্টাইলিশ গয়না যখন-তখন যে কোনওভাবে প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য পারফেক্ট। তার ওপর ধাতু, ডিজাইন এইসব পরিবর্তনের পাশাপাশি জুয়েলারি ডিজাইনাররা বিক্রি বাড়াতে নতুন মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিও নিয়েছেন। যেমন সোয়ারোস্কি (Swarovski) নামের এই সংস্থা আহলুওয়ালিয়াসহ ১১ ভারতীয় সংস্থা এবং ডিজাইনারের সঙ্গে চুক্তি করে নিয়েছে। এর ফলে ওদের পরিচিতি বাড়ছে। সোয়ারোস্কিতে যারা আসছেন তাদের অনেকেই এনাকে চেনেন না বা ওর কাজও দেখেননি। সোয়ারোস্কি নিজের ব্যবসার স্বার্থেই সেই পরিচিতি দিচ্ছে আমাদের। তাছাড়া ক্রেতারা ডিজাইনার গয়না পাচ্ছেন, বাঁধা গতের বাইরে অনেক ডিজাইন পাচ্ছেন যেখানে পাথর ব্যবহারের বাড়াবাড়ি নেই। তারা চান না বিয়ের ঝঞ্জাট কেটে গেলেই গয়না লকারে পড়ে থাকুক। কস্টিউম জুয়েলারি সবসময় পড়া যায়। তাই তার চাহিদা বাড়ছে।
বাৎসরিক বিক্রি কত সেটা স্পষ্ট না করলেও এনা জানান, তার কালেকশান বেশিরভাগ অর্থাৎ প্রায় ৭৫ শতাংশ গয়না বিক্রি হয় অনলাইনে। ইনস্টাগ্রামে ২১ হাজার ফলোয়ার আছেন। ব্যবসার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া বড় মাধ্যম। দ্রুত পরিচিতি বাড়ছে নতুন ডিজাইনারদের। রিটেল মার্কেট থেকে দিনের পর দিন সময় দিয়েও যেটা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে পরিচিতির জন্য বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করতে হয়। যার খরচ অনেক বেশি।
শুধু ডিজাইন নয়, নানা ম্যাগাজিন, সংবাদপত্রে লেখালেখিও করে ব্যস্ত সময় কাটে এনার। আর ভালোবাসেন ঘুরে বেড়াতে। যখন যেখানে গিয়েছেন নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। গয়না ডিজাইনে সেসবই ফুটিয়ে তুলেছেন এনা।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)