ক্যাপশন- ট্রান্সফারওয়াইজ আজ একটি দুনিয়াজোড়া ব্যবসা

নিজের ছোট্ট একটি ভুলের জন্য উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান পারলে নিজেকেই নিজের গায়ে লাথি মারেন। তিনি নিজেও জানতেন না যে তাঁর এই ছোট্ট ভুল থেকেই জন্ম নিতে যাচ্ছে এমন এক ব্যবসা, যার বর্তমান বাজারে মূল্য ১২০ কোটি ডলারেরও বেশী।

আজকে উদ্যোক্তা বার্তায় বিদেশি উদ্যোক্তা পর্বে আমরা এমন এক ব্যবসার উদ্যোগের কথা জানবো যা আমাদের দেশের নাগরিকরা যারা বিদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠান, তার অনেকগুলো মাধ্যমের মধ্যে একটি হলো “ট্রান্সফারওয়াইজ”। আলোচনা করছি এর উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমানকে নিয়ে। যিনি টাকা পাঠানোর ব্যবসা ট্রান্সফারওয়াইজ’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং এখন কাজ করছেন এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে।

উদ্যোক্তার মাথায় ব্যবসার ভাবনা আসে ২০০৮ সালে, যখন তিনি লন্ডনে ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন। এস্তোনিয়া শহর থেকে আসা ক্রিস্তোর বয়স তখন ২৮ বছর। ঠিক সেই বছর তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রিস্টমাসের বোনাস পেলেন প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড।

উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান যখন এস্তোনিয়াতে থাকতেন তখন সুদের হার লন্ডন থেকে অনেক বেশি। তাই ক্রিস্তো ঠিক করলেন তিনি তাঁর ইউকে চলতি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বোনাসের টাকাটা এস্তোনিয়ায় নিজের সঞ্চয়ী হিসাবে পাঠিয়ে দেবেন, ফলে অনেক বেশি টাকা তিনি সেখানে সুদ হিসেবে পাবেন।

বয়স যখন ৩৮ ঠিক তখন উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান তার এই ভাবনা থেকে তাঁর কর্মস্থল লন্ডন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ১৫ পাউন্ড ফি দিয়ে ১০ হাজার ডলার পাঠিয়ে দিলেন তাঁর নিজ শহর এস্তোনিয়ান ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পাঠানোর এক সপ্তাহ পর উদ্যোক্তা লক্ষ্য করেন যে তার ধারণার চেয়ে ৫০০ পাউন্ডের সমপরিমান অর্থ কম জমা হয়েছে।

সেই মুহূর্তে উদ্যোক্তা খোঁজ নিতে শুরু করলেন আসলে ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছে। বিষয়টি পরিস্কার করে জানার পর উদ্যোক্তা বুঝতে পারলেন কত বড় বোকা তিনি।

উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান বলেন- ‘আমি বোকার মত আশা করছিলাম যে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও ব্লুমবার্গে যে মুদ্রা বিনিময় হার আমি দেখেছিলাম, আমার ইউকে ব্যাংক ঠিক সেই হারই আমাকে দেবে। আসলে ব্যাংক আমার ক্ষেত্রে যে বিনিময় হার ব্যবহার করেছিলো, তা ছিলো ৫ শতাংশ কম। আর এক্ষেত্রে আমার ব্যাংক এবং অন্য সব ব্যাংকই তাই করে, এটা করে তাদের ব্যবসার জন্য। এটা ছিলো আমারই ভুল’।

পরবর্তীতে উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান নিজের এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তখনই প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি বিদেশে টাকা পাঠানোর এমন এক উপায় খুঁজে বের করবেন যেখানে ব্যাংকের কোনো হাতই থাকবে না।

ট্রান্সফারওয়াইজ ব্যবসার শুরুতে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি এবং তাঁর এস্তোনিয়ার বন্ধু তাভেত হিনরিকাস। টেলিযোগাযোগ কোম্পানি স্কাইপের এই পরিচালকের সঙ্গে উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান অনানুষ্ঠানিকভাবে টাকা-পয়সা লেনদেন করতেন।

শুরুর দিকে এই ব্যবসা ভালোভাবে কাজ করছিলো কারণ উদ্যোক্তা কিস্তো প্রায়ই পাউন্ডের সঙ্গে তখনকার এস্তোনিয়ান মুদ্রা ক্রুনের বিনিময় করতেন। আর তাভেত করতেন উল্টোটা। তাঁরা এক্ষেত্রে বেছে নিতেন দিনের গড় বিনিময় হার, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট দিনে যেসব দামে একটি মুদ্রা বেচাকেনা হয়, তার গড় দাম।

কিছুদিনের মধ্যে উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান এস্তোনিয়ান বন্ধুদের দ্বারা একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন- এরা এস্তোনিয়া এবং দেশের বাইরে থাকা বন্ধুদের একটি দল। তাঁরা সবাই ঠিক একইভাবে মুদ্রা বিনিময় ব্যবহার করা শুরু করেন।

আর ঠিক তখনই ক্রিস্তো কারমান এবং এস্তোনিয়ার বন্ধু তাভেত হিনরিকাস বুঝতে পারেন যে এটিকে একটি সাফল্যজনক ব্যবসায় পরিণত করা যেতে পারে।

আর তাই উদ্যোক্তাদ্বয় ২০১১ সালে লন্ডনে চালু করেন ট্রান্সফারওয়াইজ – এটি একটি আর্থিক প্রযুক্তি বা ফিনটেক ওয়েবসাইট, যা ব্যবহার করে যে কেউ দেশের বাইরে অন্য মুদ্রায় অর্থ পাঠাতে পারেন, আর এক্ষেত্রে বিনিময় হার হবে দিনের গড় বিনিময় হার এবং ফি হবে একেবারে নির্দিষ্ট মাত্র ০.৫ শতাংশ।

আজ ট্রান্সফারওয়াইজ একটি দুনিয়াজোড়া ব্যবসা, আর এতে বিনিয়োগ করেছেন ভার্জিনের মালিক স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন এবং পেপ্যালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্স লেভচিন।

ব্যবসা শুরুর দিকে প্রথম বছরে উদ্যোক্তা ক্রিস্তো এবং তাভেত ব্যবসার পিছনে নিজেদের জমানো টাকা বিনিয়োগ করেছেন। শুরুর দিকে একজন-দু’জন করে কাস্টমার পেয়েছেন তাঁরা। এর-ওর কাছ থেকে শুনে গ্রাহকরা এই ওয়েবসাইট ব্যবহার করতেন। কিন্তু পরে একটি প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইটে ইতিবাচক রিভিউর পর গ্রাহক সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে শুরু করে।

আইনগত ঝামেলা এড়াতে উদ্যোক্তা ক্রিস্তো ও তাভেত ব্রিটেনের তৎকালীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস অথরিটির কাছ থেকে অনুমতি এবং লাইসেন্স নিয়ে নেন ওয়েবসাইট শুরুর আগেই।

২০১২ সালে বিনিয়োগকারী খুঁজতে শুরু করেন, কিন্তু প্রথমে কেউ এগিয়ে আসতে চায়নি। এ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তা ক্রিস্তো কারমান বলেন, ‘আমরা ১৫ জন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সেই বিনিয়োগকারীরা সবাই আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। ইউরোপের কেউ আমাদের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চাইছিলো না। ওই সময়ে ইউরোপীয়রা অ্যামেরিকানদের চেয়ে কম ঝুঁকি নিতে চাইতো’।

উদ্যোক্তাদ্বয় ট্রান্সফারওয়াইজের জন্য প্রথম বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেন নিউইয়র্কের একটি ছোট তহবিল থেকে যার নাম ‘আইএ ভেঞ্চারস’।

ট্রান্সফারওয়াইজ এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে আজকে ট্রান্সফারওয়াইজের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০.৫ কোটি ডলার।

পৃথিবীর চল্লিশ লক্ষ মানুষ এখন এই অ্যাপ ব্যবহার করে, আর ৫০টি দেশের ৪৯টি মুদ্রার বিনিময়ে এটি ব্যবহার করা হয়। কোম্পানিটি বলছে, প্রতি মাসে ট্রান্সফারওয়াইজ ব্যবহার করে ৩০০ কোটি পাউন্ড বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়।

ট্রান্সফারওয়াইজের দ্বিতীয় বৃহত্তম অফিস এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিন-এ। এর বার্ষিক লাভের পরিমান ৬২ লক্ষ পাউন্ড। আর কর্মীর সংখ্যা ১,৪০০।

ট্রান্সফারওয়াইজ বর্তমান বাজারে খুব দ্রুত বেড়ে উঠেছে কারণ সস্তায় মানুষজন এটি ব্যবহার করতে পারে, আর এটি ব্যবহারে কোনো লুকানো খরচ নেই।

২০১২ সালে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ট্রান্সফারওয়াইজকে ইস্ট লন্ডনের ২০ টি ‘হটেস্ট টেক স্টার্টআপস’র একটি হিসাবে নামকরণ করা হয় ‘স্টার্ট আপ দ্য উইকড যুক্তরাজ্য’।

এছাড়া টেকক্রাঞ্চের ২০১২ ইউএস ডেমো দিবসে সিডক্যাম্পের ২০১২ ইউএস ডেমো ডে-তে পাঁচটি ‘স্টার্ট-আপস’ এর মধ্যে একটি ছিলো ট্রান্সফারওয়াইজ এবং এটি ২০১২ সালের শীর্ষ ১০০ ইউকে স্টার্ট আপগুলোর তালিকায় স্টার্টআপস.কমের তালিকায় স্থান পায়।

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here