ফোনে কথা হল উদ্যোক্তা আসমা খাতুন আশার সাথে। তিনি ডাকলেন তার ফ্যাক্টরিতে,তার বাসার এক রুমেই তার ফ্যাক্টরি। গেটে ঢুকতেই বললেন দাঁড়ান দাঁড়ান। এগিয়ে দিলেন স্পঞ্জ স্যান্ডেল এবং বললেন, স্যান্ডেলটি পড়ুন এবং হাত ধুয়ে তারপর প্রবেশ করুন”। তাতে বুঝতে বাকি রইলনা তিনি কতটা সচেতন। তারপর তার ফ্যাক্টরিতে প্রবেশের পর দেখা গেল মিষ্টি বানানোর কর্মযজ্ঞ চলছে। কেউ দুধ থেকে ছানা কাটছে, কেউবা সে ছানাকে মিষ্টির আকার দিচ্ছে। হরেক রকম মিষ্টি। উদ্যোক্তা জানালেন প্রায় পঞ্চাশ রকমের মিষ্টি তৈরি করতে পারেন।
হাসিমুখে কথা শুরু করলেন উদ্যোক্তা আশা, “লকডাউনের মাঝে শোরুম বন্ধ ছিলো, কর্মীরা ছুটিতে। আমি ঢাকায় ছিলাম কোথাও যাইনি। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কয়েকদিন পর আমার নিয়মিত কাস্টমারদের ফোন আসা শুরু হলো। ১৩ এপ্রিল থেকে পাঠাও ডেলিভারি ম্যানদের দিয়ে আবার হোম ডেলিভারি শুরু করলাম। আমি কাজটা জানতাম তাই নিজেই কাজ করতাম কোন কর্মী ছাড়া”।
করোনার সময়েও তিনি মাসে দেড় লক্ষ টাকার বিক্রি করেছেন। এখন সেটা প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ। শুরুতে চার-পাঁচ রকমের মিষ্টি তৈরি করলেও আজ তিনি প্রায় ৫০ রকমের মিষ্টির কারিগর। রসগোল্লা, রসমালাই, লাল চমচম, সাদা চমচম ,পোড়াবাড়ির চমচম, রাজভোগ, মালাইকারি, ব্লাকটোষ্ট, ক্রিমটোষ্ট, বুরিন্দা, কালোজাম, লালমোহন, গোলাপ জামুন,মাওয়াজাম, ক্ষীরটোষ্ট, বেবি সুইট, ছানার কেক, সন্দেশ, কাচাছানা, মালাইরোল, গুড়ের রসগোল্লা, গুড়ের ছানা, ছানার জিলাপিসহ দই, পিজ্জা এবং অনেক রকমের কেক দিয়ে সাজানো তার দুইটি শো-রুম। মোহাম্মাদপুরের সেই দুইটি শো-রুম ও কারখানা মিলে উদ্যোক্তা ও তার হাসবেন্ডসহ মোট ১২জন কর্মী নিয়ে চলছে তার কর্মযজ্ঞ।
ফুড পান্ডা, পাঠাও থেকে শহরের নামীদামী ব্র্যান্ডগুলোতে সরবরাহ করেন তার তৈরী এসব মিষ্টি। সুনাম অর্জন করার পাশাপাশি বেশ কিছু সম্মাননাও পেয়েছেন এই সফল উদ্যোক্তা।
উদ্যোক্তা ভারাক্রান্ত সুরে বলেন, “আজ আমি প্রায় পঞ্চাশ রকমের মিষ্টি তৈরি করতে পারি কিন্তু সেই শুরুতে আমি রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি কিন্তু কেউ আমাকে শেখায়নি। ছেঁড়া পোশাক পরে আমি গিয়েছি। তারা কেউ বুঝতে পারেনি যে আমি পড়াশোনা করা শিক্ষিত একটা মেয়ে তারা ভেবেছে আমি শ্রমিক”।
আশা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেন, পাশাপাশি সংসার-সন্তান সামলাতে গিয়ে ২০১২ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
দীর্ঘদিন পর ২০১৮ সালে সন্তানের জন্য নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তায় ঘরেই মিষ্টি তৈরি আরম্ভ করেন। তৈরিকৃত এসব মিষ্টির মান এবং স্বাদে সকলেই তার প্রশংসা করতো। তখনই কাজটি বাণিজ্যিকভাবে করার চিন্তা মাথায় আসে। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিলেন। শুরু হলো পণ্য প্রস্তুত পর্ব এবং বাজারজাতকরণের চ্যালেঞ্জ। একটু একটু করে তার পরিচিতি বাড়তে থাকে। বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করা শুরু করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথম আমি হাফ কেজি মিষ্টি বিক্রি করতে পেরেছিলাম তারপর তিনদিন আর কোন বিক্রি হয়নি। কেউ ছিলনা একা একা দোকান খুলে চুপচাপ বসে থাকতাম আর ভাবতাম আমি কি পারব? আমাকে যে পারতেই হবে। তারপর আবারো ১০০ গ্রাম ২০০ গ্রাম এভাবে বিক্রি হয়েছে। জীবনের প্রথম উপার্জিত মিষ্টি বিক্রির টাকা ২০০।
আসার ইচ্ছা ভবিষ্যতে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান করতে চান। তার মৃত্যুর পর যেখানে সমাজের অবহেলিত যত নারী আছেন সেখানে তারা কাজ করবেন। সে প্রতিষ্ঠান থেকে যে অর্থ উপার্জন হবে সেই খরচে তারা চলবে। তিনি আরও বলেন, উদ্যোক্তাকে সমাজের কোন শ্রেনীর মানুষের সেবা করবে তা ঠিক করে নিতে হবে। উদ্যোক্তা কে দাম নির্ধারণ করা নিয়ে সতর্ক হতে হবে। লভ্যাংশ যেন ৪০% এর বেশি না হয়। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত দাম যেন না চাপিয়ে দেয় কাস্টমারদের উপর। সেই সাথে গুণগত মানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সময় বুঝে কাজ করতে হবে। তবেই একজন উদ্যোক্তা তার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।
বিপ্লব আহসান