জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ খাবার নষ্ট হয়। বিশ্বের দেশগুলোর র্যাংকিংয়ে দেখা যায়, খাদ্য বর্জ্য যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদনকারী হল ডেনমার্ক। সেই ধারণা থেকেই পাঁচ জন ড্যানিশ উদ্যোক্তা কয়েক বছর আগে অনলাইনে একটি মার্কেটপ্লেস চালু করেছিলেন।
উন্নত বিশ্বের রেস্তোঁরা এবং দোকানগুলো তাদের কী কী অবশিষ্ট খাবার থাকে সেগুলো সংগ্রহের জন্য সময় পোস্ট করে এবং সাধারণ মানুষ অ্যাপের মাধ্যমে ছাড়যুক্ত খাবারগুলো কিনতে পারেন। উদ্বৃত্ত খাবার ফেলে দেয়া থেকে বাঁচানো হয় এবং অ্যাপ্লিকেশনটি বিক্রি করা খাবারের ছোট একটি অর্থ উপার্জন করে।
আজ আমরা জানবো খাদ্য-বর্জ্য অপচয় রোধকারী অ্যাপ ‘টু গুড টু গো’র প্রধান নির্বাহী মেটে লিক’র জীবনের সফলতার শুরুর দিকের গল্প।
‘টু গুড টু গো’ সংস্থাটি ডেনমার্কে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অ্যাপ্লিকেশনটি সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, জার্গেন মুনটার প্রভিন্সে এ প্রথম চালু করা হয়। এটি হলো একটি বিনা খরচায় মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন যা গ্রাহকদের রেস্তোঁরা এবং স্টোরগুলোতে সংযুক্ত করে যে খাবারগুলো উদ্বৃত্ত হিসেবে থেকে যায় যা পরবতীতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে স্বল্প মূল্য বিক্রি করা হয়।
ব্রায়ান ক্রিস্টেনসেন, টমাস বজর্ন মোমসেন, স্টায়ান ওলসেন, ক্লাউস ব্যাগে পেডারসেন এবং অ্যাডাম সিগব্র্যান্ডসহ- এই ছয় জন উদ্যোক্তা ‘টু গুড টু গো’ অ্যাপ্লিকেশনটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ২০১৭ সালে মেটে লিক সিইও হিসাবে যোগদান করেন।
২০১৬ সালের আগস্টে ডেনমার্কের মেটে লিকে ও তার সহকর্মী ডেনস-সহ আরো কয়েকজন উদ্যোক্তা এই মিশন শুরু করে। খাদ্য অপচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই ছিলো সেই মিশনের উদ্দেশ্য। আর এই মিশনের নাম ছিল ‘টু গুড টু গো’।
অ্যাপ্লিকেশনটির প্রধান নির্বাহী মেটে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্যের বর্জ্য সমাজে আসলে কত বড় বিষয় এই সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত ছিলাম না। আরো গবেষণা করার পরে এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পেরে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যা জেনে আমার মন খারাপ করে দিয়েছে’।
উদ্যোক্তা মেটে বলেন, এটি সত্য যে আমরা এত বড় একটি সমস্যা সমাধান করতে এবং প্রক্রিয়াটিতে সবাইকে বিজয়ী হিসাবে রেখে যেতে পারি। আমি ভেবেছিলাম যে এটি সত্যিই একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
উদ্যোক্তা তার বিনিয়োগকৃত এই স্টার্টআপটিকে অনেক সাফল্যজনক বলে মনে করেন। এ জন্য তিনি পুরানো কোম্পানি আন্ডার আর্মর ছেড়ে ‘টু গুড টু গো’তে প্রধান নির্বাহী হিসাবে যোগদান করেন। তিনি বলেন, যদি আমি এতে ঝাঁপিয়ে না পড়তাম তবে আমি এতকিছু করতে পারতাম না।
উদ্যোক্তা মেটে এই প্রজেক্টটি দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য নিজে থেকে তদারকি করছেন। বর্তমানে সংস্থাটি এ পর্যন্ত ৫শ’ জন এমপ্লয়ীকে নিয়োগ দিয়েছে, প্রজেক্টটি সুইডেনে চালু হবার পর বর্তমানে ১৪ টি ইউরোপীয় দেশও এটি নিয়ে কাজ করছে। মেটে বলেন, ‘প্রথম মিলিয়ন ব্যবহারকারীদের কাছে যেতে এটি তিন বছর সময় নিয়েছিল এবং খুব ভাল করতে ১৫ মাস সময় লেগেছে। এটি আমাদের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা একটা সময় ছিল যখন আমাদের কোম্পানির তৈরিকৃত প্রযুক্তি ততদিনেপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলো’।
এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সংস্থাটি নতুন করে অতিরিক্ত ৬ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। টু গুড টু গো ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘স্প্যানিশ স্টার্টআপ’ কোম্পানিকে একীভূত করার মধ্যে দিয়ে নিজস্ব ব্র্যান্ডিংয়ের পথে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
সেই বছর নভেম্বর মাসে ফরাসি রিটেইল উদ্ভিদ কোম্পানি জার্ডিল্যান্ডের সঙ্গে অংশীদারিত্বেরচুক্তির মাধ্যমে ‘টু গুড টু গো’ এর অফার কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। যা ‘টু গুড টু গো’ ব্যবসাকে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এরই ধারাবাহিকতায় সে বছর ডিসেম্বর থেকে ‘টু গুড টু গো’ ফরাসি মুদি খুচরা দোকান ইন্টারমার্চির সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা করে আসছে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ‘টু গুড টু গো’ ফরাসী দাতব্য রেস্তোঁরা ‘দু সিউরকে’ 60 মিলিয়ন ইউরো অনুদান দিয়েছিলো।
এটি ইউরোপের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে একটি যা বর্তমানে ১৮ মিলিয়ন মানুষ ব্যবহার করছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে পরিবেশ-সচেতন তরুণ ও বৃদ্ধ পর্যন্ত গ্রাহকরা দর কষাকষির সুযোগ পাচ্ছে এতে। বর্তমানে এটি ‘ইও সুশী’ খাবার থেকে অ্যাকর হোটেল পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি খাদ্য সরবরাহকারীদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করছে। বর্তমানে এই কোম্পানি সামাজিক প্রভাব বিস্তার করা কোম্পানি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। সেই সঙ্গে ভালো কিছু করার মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ অর্থনৈতিক রাজস্ব খাতে ইউরো যোগ করতে সক্ষম হয়েছে ‘টু গুড টু গো’।
এখন পর্যন্ত ‘টু গুড টু গো’ দলের সদস্যরা ২৫ মিলিয়নেরও বেশি খাবার বাঁচাতে সহায়তা করেছে। যা কিনা বিশ্বে মোট ৭২ টনেরও বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদন কমিয়েছে।
এ বিষয়ে উদ্যোক্তা মেটে আবারো বলেন, ‘এটি কেবল একটি সূচনা। আমরা এখনো লক্ষ্য সীমার কাছাকাছি পৌঁছাইনি। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা আরো এক বিলিয়ন খাবার অপচয় রোধ করতে চাই।”
সহযোগী গবেষণা সংস্থা মিন্টেলের বিশ্লেষক ক্যাডি মনে করেন, খাবারের বর্জ্য সম্পর্কে যখন আচরণের পরিবর্তন করার কথা আসে, তখন গ্রাহকরা পুরষ্কারের জন্য আরো ভাল সাড়া দেন। ‘টু গুড টু গো’ অ্যাপ্লিকেশনটি ছাড়ের ভিত্তিতে দিনের খাবারের প্রচারের মাধ্যমে বেঁচে যাওয়া খাবার খাওয়াকে স্বাভাবিক করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েক ডজন সংস্থা এটিকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হয়েছে। যার মধ্যে ওলিও, ফুডক্লাউড এবং কারমা’র মতো প্ল্যাটফর্মগুলোও রয়েছে।
উদ্যোক্তা মেটে খাদ্য-বর্জ্য অপচয় রোধকারী অ্যাপ ‘টু গুড টু গো’ সম্পর্কে বলেন, ‘এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং স্কুলগুলোতে খাদ্য বর্জ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি গ্রাহকদের ক্ষমতায়নে কাজ করছে’।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)