উদ্যোক্তা-জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া

জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া। আদিনিবাস পাবনাতে হলেও বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াতে হয়েছে পরিবারের সঙ্গে। একটা সময় বগুড়া শহরের চকলোকমান এলাকার খন্দকার পাড়ায় চলে আসেন এবং সেখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করে মহুয়ার পরিবার। মরহুম পিতা আব্দুল মজিদ ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা এবং মা ছাহেরা বিবি গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ২০১২ সালে ফয়েজুল্বা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ফাইভ অর্জন করেন। এরপর শাহসুলতান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন মহুয়া।

কথাগুলো শুনতে সহজ লাগলেও মহুয়ার জীবনযুদ্ধ মোটেও সহজ ছিল না। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় আর পাঁচজনের মতো চলাফেরা করতে পারেননি মহুয়া। স্কুল-কলেজে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া-আসা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরানো সকল কাজের সঙ্গী মা ছাহেরা বিবি। জান্নাতুল ফেরদৌস মহুয়া শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও মানসিকভাবে তিনি আর পাঁচজনের থেকে বেশি শক্তিশালী।

ছোটবেলা থেকেই ঠিক করেছিলেন- ‘আমি নিজের অর্জনে চলবো, কারো ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল হবো না’।

‘পুতুল খেলার বয়সে নিজের পুতুলের পোশাক তৈরি শেখা থেকে মায়ের হাতে সেলাই শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল আমার’ – এমনটি বলছিলেন মহুয়া। সবাই যখন খেলাধুলা বা অন্যান্য কাজ করতো তখন থেকে তার সঙ্গী ছিল বই এবং নতুন নতুন সেলাই শেখা। এভাবে আস্তে আস্তে সুঁই-সুতোর কাজে পারদর্শী হয়ে উঠলেন মহুয়া।

তিনি বাসার আশপাশে বাচ্চাদের টিউশন পড়াতেন এবং যে টাকা পেতেন তা জমিয়ে রাখতেন। এভাবে ৭ হাজার টাকা জমলো তার। সে টাকা দিয়ে স্মার্টফোন কিনলেন মহুয়া। তারপর বন্ধু-বান্ধবদের পরামর্শে অনলাইনে একটি কাজ শুরু করলেন। অন্যের পোশাক বিক্রি করে দিতেন মহুয়া। কিছু দিন পর প্রতারণার শিকার হলেন প্রায় ৬ হাজার টাকা লোকসান হলো তার। সে সময় মহুয়ার মন সামান্য খারাপ হলেও ভেঙে পড়েননি তিনি। সম্মান প্রথম বর্ষে পড়াশোনারত অবস্থা থেকেই তিনি বাসার আশপাশে হাতের কাজের পোশাক তৈরি করে বিক্রি করতেন। ফেসবুকে ‘Rainbow-রংধনু’ নামে একটি পেজ চালু করলেন। পরবর্তীতে তিনি ফেসবুকে ‘উই’ সহ বেশ কিছু গ্রুপে যুক্ত হন। ‘উই’ মহুয়ার জীবন পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

গত এক বছরে উই থেকে ৭ লক্ষ ১০ হাজারের বেশি টাকার পোষাক বিক্রি করেন মহুয়া। শুরুতে কোন কর্মী ছিল না তার। তিনি কাপড় এবং সুতা বলে দিতেন সে অনুযায়ী মা দোকান থেকে এনে দিতেন। বর্তমানে তার ৩৫ জন কর্মী রয়েছে। প্রথমে ৫ টি ড্রেস নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। সবগুলোই ছিল থ্রিপিস। বর্তমানে তার পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে শাড়ি, ওয়ানপিস, টুপিস, থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, বিছানার চাদর, কূর্তি, টপস সহ অসংখ্য পণ্য। তিনি তার আশপাশে যে সকল মহিলাদের কাজ প্রয়োজন তাদের খুঁজে কাজ দেন। তার এমন কর্মকাণ্ডে গর্বিত পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সহ এলাকাবাসী।

কাজের সুবিধার্থে তিনি বর্তমানে বগুড়ার শেরপুরের চন্দিপুর গ্রামে মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। মাসে ৬০/৭০ হাজার টাকা আয় করছেন মহুয়া। দেশের বেশিরভাগ জেলায় মহুয়ার পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে। দেশের বাইরে ১৭ টি দেশে পণ্য পাঠান তিনি। ভবিষ্যতে একটি কারখানা স্থাপন করতে চান তিনি, যেখানে কাজ দিতে চান প্রতিবন্ধী এবং অসহায় মহিলাদের। নিজের হাতে ধরে তাদের কাজ শেখাতে চান মহুয়া।

তরুণদের উদ্দেশে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আত্মনির্ভরশীল হওয়ার একটি আলাদা শক্তি আছে যে শক্তি প্রতিটি নারীর থাকা উচিত। তাই সকলে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। বাধা তো আসবেই মনে সাহস রেখে সেগুলো জয় করুন দেখবেন সফলতা আপনার দুয়ারে কড়া নাড়ছে।

তামান্না ইমাম
রাজশাহী ডেস্ক, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here