বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কাজ করছেন শিউলি আচার্য। রাজধানীর বাইরে কুমিল্লার মতো শহরে একজন নারী সারাদিন দোকানে বসে হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল, গিটারের মতো বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে বিক্রি করছেন।
শিউলির ঠাকুরদা শিরিষ আচার্য ১৯৪৫ সালে কুমিল্লা জেলা শহরে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। নিজ বাড়িতেই তিনি হারমোনিয়াম-তবলা বানিয়ে বিক্রি করতেন। শিরিষ আচার্যের ছেলে অর্থাৎ শিউলির বাবা নীহার রঞ্জন আচার্য ব্যবসাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কুমিল্লার রাণীরবাজার এলাকায় ‘তারক মিউজিক’নামে বাদ্যযন্ত্রের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলেন। প্রতিষ্ঠানটি বেশ প্রচার পায়। সেই সুবাদে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায়েও প্রসার ঘটে। ফলে গত অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে কুমিল্লা শহরে ব্যবসা করেন নীহার রঞ্জন আচার্য। ২০২০ সালে অক্টোবর মাসে তিনি প্রয়াত হন।
নীহার রঞ্জন আচার্যের চার মেয়ের মধ্যে বড় দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। তাই তার মৃত্যুর পর ব্যবসায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও তা দূর হতে বেশি দিন লাগেনি। অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবসার হাল ধরেন ছোট মেয়ে শিউলি আচার্য। তিনি দেড় বছর ধরে বেশ ভালোভাবেই চালাচ্ছেন ‘তারক মিউজিক’।
১৯৯৪ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বাবা তাকে নিজ হাতে ব্যবসা বোঝাতে শুরু করেন। কোন জায়গা থেকে কাঠ কিনতে হবে, তামা কিনতে হবে কীভাবে, কোনটির দাম কত– এসব বিষয়ে সব সময়ে বাবার সঙ্গে কথা বলতেন শিউলি। একসময় ঘরে বসেই বাবার ব্যবসায়ের যাবতীয় হিসাব-নিকাশও দেখতে শুরু করেন। অনেক সময় বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বাজারে গিয়ে কাঠসহ বাদ্যযন্ত্র বানানোর জিনিসপত্র কিনে আনতেন। তখন অনেকটা নীহার রঞ্জন আচার্যের সহকারি হিসেবেই কাজ করতেন শিউলি আচার্য।
তিনি বলেন, ‘বাবা নিজ হাতে এই ব্যবসার জন্য আমাকে প্রস্তুত করেছেন। এ ছাড়া আমার মা জ্যোতি আচার্য নিজেও গানবাজনা করতেন। তাই এ ধরনের ব্যতিক্রমী ব্যবসায়ে আসতে মায়ের কাছ থেকে কোনো বাধা পাইনি।’
বাদ্যযন্ত্রের মতো ব্যতিক্রমী ব্যবসাকে তিনি বহুদূর এগিয়ে নিতে চান। তিনি মনে করেন, সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এ দেশের নারীরাও ব্যবসা করতে পারেন। তবে এ জন্য চাই একটু সুযোগ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন শিউলি আচার্য। উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি তা করেননি, বরং বাবার অনুপ্রেরণায় পারিবারিক ব্যবসায়ে জড়িত হয়েছেন।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। ‘তারক মিউজিক’-এ তার বাবার কোনো চেয়ার-টেবিল ছিল না। ফ্লোরে বসেই তিনি বেচাকেনা করতেন। এখন শিউলি আচার্যও বাবার মতো ফ্লোরে বসেই বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও বিক্রির কাজ করে থাকেন। তবে করোনার মধ্যে তিনি ব্যবসায়ে বড় পরিবর্তন এনেছেন। অনলাইনে বাদ্যযন্ত্র বিক্রির ফরমায়েশ নিয়ে হোম ডেলিভারি দেন। এছাড়া আগে যেখানে ‘তারক মিউজিক’-এ শুধু হারমোনিয়াম-তবলা বিক্রি হতো, এখন সেখানে বাঁশি, গিটার, দোতরা, বেহালা, কাহন, জিপসি—এসব বাদ্যযন্ত্রও বিক্রি হচ্ছে।
সংগীতের প্রতি তীব্র ভালোবাসা রয়েছে আচার্য পরিবারের। শিউলি জানান, তার বাবা নীহার রঞ্জন আচার্যের ওস্তাদের নাম ছিল তারক। তাই ওস্তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়েই নীহার রঞ্জন প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন ‘তারক মিউজিক’।
প্রতিষ্ঠানটি নতুন বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও বিক্রির পাশাপাশি পুরোনো যন্ত্র সারাইয়ের কাজও করে। তবে করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা কমেছে। আগে সব মিলিয়ে মাসে দু-তিন লাখ টাকার বাদ্যযন্ত্র বিক্রি হতো। এখন মাসে বিক্রি হয় এক-দেড় লাখ টাকার।
তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এই ব্যবসায়ে আনবো। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই ব্যবসায় বসাবো। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সংগীত ভালোবাসতেন। সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী প্রজন্মও সংগীতকে যেন ভালোবাসে, সেই ব্যবস্থা করব।’
শিউলি আরও বলেন: যারা এখানে আসেন, তারা খাঁটি মানুষ। তারা গানবাজনা নিয়ে থাকেন। তাদের সঙ্গে থাকলেও ভালো লাগে, মন ভালো হয়ে যায়।
সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা