নগরায়নের ফলে আবাদী জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। ইট-পাথরের শহরে অবসর সময় কাটাবার একমাত্র সঙ্গী ছিল ঘরের বারান্দা কিংবা ছাদ। সেই বারান্দা কিংবা ছাদে শোভা পেতো পছন্দের ফুল গাছগুলো। পড়ন্ত বিকেলে এককাপ চা হাতে নিজের লাগানো গাছগুলোর সাথে সময় কাটানো ছিল নিত্য নৈমিত্তিক শখের বিষয় ছিল অনেকের। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে মানুষের চিন্তা ভাবনায়। সেই পরিবর্তনের ধারা থেকেই ছাদবাগান আজ ছাদকৃষিতে রূপ নিয়েছে।
এর পেছনে কাজ করেছে একজন মানুষের ধারাবাহিক প্রয়াস। তিনি শাইখ সিরাজ। টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক নানা প্রেরণামূলক অনুষ্ঠান করে দেশের মানুষকে চমৎকৃত করছেন তিনি। ১৯৮০ সাল থেকে ছাদে কাজি পেয়ারার গাছ লাগানো দিয়ে প্রচারণা শুরু করেছিলেন। ছাদবাগান থেকে ছাদকৃষি,এই রূপান্তরের কাজটি ব্যাপকভাবে ঘটেছে গত ৭-৮ বছরে। শুধু রাজধানী নয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শহরে বাড়ির ছাদে বাগান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ছাদ কৃষির প্রতি নগরবাসীর আগ্রহ বাড়ছে দিনকে দিন। আজকাল ছাদগুলোতে আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, বড়ই, কদবেল, আমড়া, স্ট্রবেরি, মাল্টা, ডালিম, আনার, লটকন, কামরাঙা, লেবু ইত্যাদি; এমনকি ভিয়েতনামের ছোট জাতের নারকেলের চাষও হয় ছাদকৃষিতে। আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা ছাদে চাষোপযোগী নানা প্রজাতির আবিষ্কার ও সন্ধান দিয়ে আবাদ সহজ করে দিয়েছেন। ফলে বহুমাত্রিক সুবিধা ও সাফল্যের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ছাদকৃষিতে।
শুধু ফুল, ফলেই সীমাবদ্ধ না থেকে আগ্রহীরা চেষ্টা করছেন সবজির প্রয়োজনও নিজ উদ্যোগে মেটাতে। কাঁচামরিচ, সিম, লাউ, টমেটো, বেগুন, বিভিন্ন প্রকারের শাক ও অন্যান্য সবজি ছাদে ফলানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেকে। ছাদকৃষক হওয়ার এখনই সময়! ছাদে সবজিটা ভালো হয়, দ্রুত ফলন হয়। মানুষ তাই সবজি চাষে ঝুঁকছেন বেশি। কয়েক বছরেই ফলন হয়, এমন ফলের গাছও অনেক আছে। ছাদকৃষকের জন্য তা সুখবর।
কাঠগোলাপের প্রতি ভালবাসা থেকে লুবনা জাহান লাবণী গড়ে তুলেছেন কাঠগোলাপের বাগান যা থেকে তিনি আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন। সেই সাথে ছাদকে তিনি পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। লাবণীর মতো অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা ছাদকৃষির মাধ্যমে তাদের উদ্যোগের পথটি বেছে নিচ্ছেন। কেউ ক্যাকটাস কিংবা নানা জাতের পর্তুলিকা নিয়ে কাজ করছেন। কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন গাছের চারা নিয়ে নার্সারি গড়ে তুলছেন ছাদেই। ছাদকৃষির সফলতায় চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার পারভীন আক্তার ও পাহাড়তলী থানার শবনম আরা বেগমের জাতীয় বৃক্ষরোপণ পুরষ্কার অর্জন করার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এই উদ্যোক্তারা ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো ছাদকৃষিকে অণুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ছাদবাগান বা ছাদকৃষির উপযোগিতা অনেক। ফলের উৎপাদন-বর্ধন-পাকানো এবং বিভিন্ন রকম সবজির চাষে প্রায়ই এমন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যা স্বাস্থ্যহানিকর। তাছাড়া আমদানি করা ফলকে পচাগলা থেকে রক্ষার জন্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে ছাদকৃষি হতে পারে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাধ্যম। নির্বিষ ফল-সবজি উৎপাদিত হতে পারে সেখানে।
ছাদকৃষির জন্য গ্রিন সেভার্সের কিছু পরামর্শ রয়েছে:
- পর্যাপ্ত রোদ পায়, এমন জায়গা বাছতে হবে। পানির সরবরাহ ভালো থাকা চাই।
- টব বা ড্রাম মেঝে থেকে সামান্য উঁচুতে বসাতে হবে। ঘেঁষাঘেঁষি বসাবেন না। প্লাস্টিকের ড্রামে প্রচুর গ্যাস হয়। মোটা টিনের ড্রাম ভালো করে রং করে নিন। সবজি বুনবেন টুকরো খেত বা বেড তৈরি করে।
- ফলসহ গাছ কিনবেন না। নার্সারিতে ফলন দেওয়া গাছের বয়স বেশি থাকে। বাড়িতে নিয়ে এলে বেশি দিন আর ফল দেবে না।
- সচরাচর তিন বছর বয়স থেকে একটি গাছের ফলন ভালো হয়। ফল দেয় সাত থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত। সুতরাং একটু ছোট গাছ কিনুন।
- গাছে বেশি পানি দেবেন না। পানির পরিমাণ এমন হবে, যেন ৩০ মিনিটের মধ্যে মাটি তা শুষে নিতে পারে।
- মাটির যত্নে বিশেষ মনোযোগ চাই। দরকারমতো সার দিতে হবে। নিয়মিত নিড়ানি দিতে হবে। শিকড় পর্যন্ত খাবার পৌঁছাতে মাটি আলগা করে দিতে হয়।
- পোকা বা রোগে আক্রান্ত পাতা বা ফল ফেলে দিতে হবে। তাহলে সেগুলো ছড়িয়ে পড়বে না। বিষ না দেওয়া ভালো।
ছাদকৃষিতে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি যেমন হাইড্রোপনিক্স, অ্যাকুয়াপনিক্স ব্যবহার করে গ্রিনহাউস তৈরির মাধমে অনেক প্রজাতির বিদেশি ফুল ও ফলমূল চাষ করা সম্ভব যা সাধারণ জমিতে চাষ করা দুষ্কর। তাই ছাদ কৃষিতে জনপ্রিয় হচ্ছে হাইড্রোফনিক্স চাষাবাদ। কারণ হাইড্রোফনিক্স দ্রবণ সঠিক পরিমাণে সরবরাহ করা গেলে প্রতিটি গাছ থেকে মাঠ ফসলের চেয়ে ৮-১০ গুণ বেশি ফলন পাওয়া যাবে। এতে উৎপাদন করা যায় টমেটো, ক্যাপসিকাম, মরিচ, করলা, লেটুস, শশা, করলা, ঢেড়স ও বিভিন্ন শাকসবজি।
ছাদবাগান ও ছাদকৃষি শুধু নিজের নয়, বরং এটি দেশের জন্যও কল্যাণকর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর দিন দিন ঘনবসতিপূর্ণ হচ্ছে যা পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করছে। শহরে খালি জায়গা বলতে গেলে এখনই তেমন নেই, অদূর ভবিষ্যতে তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ অবস্থায় ছাদবাগান কিছুটা হলেও পরিবেশ অনূকুলে রাখার সহায়ক হবে। মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে এ ব্যাপারে, এখন সেই আগ্রহকে ধরে রাখা ও প্রসারিত করা নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব।
আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু বিভাগ বা অধিদপ্তর আছে। এর মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি তথ্য সার্ভিস ছাদবাগান বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছে নবীন উদ্যোক্তাদের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ‘নগর কৃষি উৎপাদন সহায়ক’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাছাড়া একই বিষয় নিয়ে কাজ করছে ‘গ্রিন সেভার্স’, ‘বাগানবাড়ি’ ইত্যাদি বেসরকারি সংস্থা।
আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নারীসমাজ ছাদকৃষির ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। তাদের সফলতার বার্তা পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে প্রায়ই। এটি আশার দিক। ছাদকৃষির ধারণা এবং উপকারিতা সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছালে অধিকতর সুফল পাওয়া যাবে।
সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা