চিংড়ি-পোলাও, কোরমা-কাবাব, ইলিশ মাছের ঝোল
অল্প এসব খেয়ে কি আর পেট হবেরে ফুল?
খাবার নিয়ে এমন অনেক মজার ছড়া আছে, আর থাকবেই বা না কেন। সুস্বাদু খাবারে মজে না এমন মানুষ দুনিয়াতে মেলা ভার। আর সেই খাবার যদি হয় শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত তাহলে তো কথাই নেই।
উদ্যোক্তা হাসিনা আনছার নাহার তেমনই একজন নিবেদিত প্রাণ যিনি স্বাস্থ্যসম্মত সুস্বাদু খাবার তৈরি করেন। সব ধরনের বেকারি, কেক, ঝাল-মিষ্টি ফ্রোজেন ফুড, ক্যাটারিং, ফাস্ট ফুড আইটেম গুলো তৈরী করেন। হাসিনা আনছার মুক্তিযোদ্ধা বাবার মেধাবী সন্তান। কুষ্টিয়া শহরের আমলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা ছিলেন কুষ্টিয়া চেম্বার অফ কমার্স এর প্রেসিডেন্ট, কুষ্টিয়া পৌরসভার কমিশনার।
কুষ্টিয়া সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এবং কুষ্টিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে লেটার সহ উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এই মেধাবী উদ্যোক্তা। ছোটবেলা থেকেই হাসিনার ইচ্ছে ছিল বাবার মতোই সমাজ সেবা মূলক কাজ করার, অসহায় দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। বাবা-মাও সব সময় উৎসাহ দিতেন মেয়েকে।
সংসার জীবনে স্বামী ও সন্তানদের সুস্বাস্থের কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে করতেই হয়ে ওঠেন একজন রন্ধন শিল্পী। ব্যবসার জন্য খাবার তৈরি করলেও তার কাছে মনে হয় সেগুলো তার পরিবার, আপনজনেরা খাবে তাই খুব যত্নে তৈরি করেন। নিত্য নতুন খাবার তৈরি করা এক রকম নেশায় পরিণত হয় হাসিনার। পরিবার ও শ্বশুর বাড়ির সকলের কাছ থেকে পেলেন প্রশংসা ও উৎসাহ। সকলের প্রশংসা ও উৎসাহে দুই ছেলের পরামর্শ ও সহযোগিতায় শুরু করেন ক্যাটারিং ব্যবসা। যাত্রা শুরু হাসিনার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান “নাহার কুকিং ওয়ার্ল্ড”।
মাল্টি কুইজিনের উপর প্রশিক্ষণ নেয়ায় সব ধরনের খাবার তৈরি করতে পারেন। বর্তমানে একজন প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন হাসিনা। তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
হাসিনা জানান, “ক্যাটারিং বিজনেস চলাকালীন সময় আমার মনে হলো আমি যে খাবারটি রান্না করছি তাতে হাইজিন হ্যাজার্ড ঠিক মত মেইনটেইন হচ্ছে কিনা তা আমার সঠিকভাবে জানা উচিৎ। তৎক্ষণাৎ আমি সিদ্ধান্ত নিই রান্নার বিষয়ে আমাকে ব্যাপক পড়াশোনা করা প্রয়োজন। আমি শাহনাজ জামান আপা ও বন্ধু পলি জামান এর পরামর্শে ইন্টারন্যাশনাল কালিনারি ইনস্টিটিউট থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রফেশনাল শেফ কোর্স লেভেল-১ কমপ্লিট করি। কোর্স চলাকালীন সময়ে হোম শেফ থেকে আমাকে ব্রিটিশ কলম্বিয়া স্কুলে বাচ্চাদের ও অভিভাবকদের ইজি ওয়ে টিফিন বানানোর লাইভ প্রোগ্রামের অফার করে। আমি বিভিন্ন রকম ইজি ওয়েতে বাচ্চাদের ও অভিভাবকদের টিফিন বানানো শেখাই। সবাই খুব পছন্দ করে”।
ইন্টারন্যাশনাল কালিনারি ইনস্টিটিউট থেকে তার ফলাফল ও দিক বিবেচনা করে স্কলারশিপ প্রদান করা হয়। বিনা খরচে, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে এসেসর পার্ট লেভেল-৪ কমপ্লিট করেন তিনি। ইউসেফ থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এর অধীনে বেকিং লেভেল-২ কমপ্লিট করে বর্তমানে তিনি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে কুকিং এর একজন এসেসর হিসেবে কাজ করছেন।
স্বামী-সংসার সবকিছু ঠিক রেখে তার ব্যবসাটি দেখতে হয়। অনেক সময় নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে। কিন্তু এই কটু কথাতে কষ্ট না পেয়ে বরং শক্তি হিসেবে নিয়েছেন তিনি। তাদের কটু কথা থেকেই উৎসাহ নিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি নারীরা শুধুমাত্র অর্থের জন্য কিছু করে না, নিজের একটি পরিচয় তৈরি করতে, অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে কিছু একটা করতে চেষ্টা করে। ইচ্ছে করলে, চেষ্টা করলে সব নারীর দ্বারাই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
তার এই সফলতার পেছনে পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশী। দেশের স্বনামধন্য বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত রান্নার বিভিন্ন রেসিপি লিখছেন হাসিনা। এছাড়াও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে নানান রকম সুস্বাদু রান্নার কৌশল দেখাছেন প্রতিনিয়ত।
হাসিনার এই পথ চলায় কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন করেন সম্মাননা সনদ ও পুরষ্কার। অর্জন করেন নারী শিল্প উদ্যোক্তা সম্মাননা। ১১ তম ইন্টারন্যাশনাল পোল্ট্রি কুকিং কনটেস্ট থেকে সেরা দশে স্থান সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজের মেধা ও দক্ষতায় বেশ ভালো একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন উদ্যোক্তা হাসিনা আনছার নাহার।
হাসিনা স্বপ্ন দেখেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার শাখা তৈরি হবে। এছাড়াও সমাজে যারা অবহেলিত, অসহায়, বিধবা, এতিম পথ শিশু রয়েছে তাদের নিয়ে কাজ করতে চান। এদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে সমাজে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে চান।
নবীন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমি মনে করি একজন সফল উদ্যোক্তা হতে গেলে সততা, ধৈর্যশীলতা, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, দৃঢ় মনোবল, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও কাজের প্রতি ভালবাসা থাকতে হবে। ব্যবসার প্রয়োজনে নবীন উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। সে যে বিষয় নিয়ে কাজ করতে চায় সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিতে হবে। কাজ করতে গিয়ে অনেক রকম সমস্যা তৈরি হবে, নানান রকম বাধা আসবে, অনেকে অনেক কটু কথা বলবে এগুলোতে মন খারাপ না করে বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দ্বিগুণ কাজ করার মনোবল তৈরি করতে হবে, সফলতা আসবেই”।
বিপ্লব আহসান