নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তাঁরই সম্মানে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস পালন করা হয়। আর নারীদের এগিয়ে যাওয়াকে উৎসাহিত করতে, সম্মান জানাতে এ দিবসে প্রতি উপজেলা থেকে ৫ জন নারীকে পাঁচ ক্যাটাগরিতে জয়িতা সম্মাননা দেয়া হয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে। অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীর ক্যাটাগরিতে সম্মাননা পেয়েছেন কিশোরগঞ্জের মেয়ে তাহমিনা কবীর। আর একই উপজেলায় মেয়ের সাথে মা নাজমুন্নাহার কবীর’ও পেয়েছেন “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” কার্যক্রমের সম্মাননা। গর্বিত জননী ক্যাটাগরিতে জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন তাহমিনার মা। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের এতদূর নিয়ে আসার জন্য ও তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবারে তিনিও হলেন জয়িতা। উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কার্যালয় যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
নারী শিক্ষার পাশাপাশি নারীরা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন আর সব সামাজিক পারিবারিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে যে অদম্য নারীরা নিজেকে এবং আরো মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে যারা সক্ষম হয়েছেন তাদের মাঝ থেকে সেরা ৫ নারীকে দেয়া হয়েছে এই সম্মাননা।
কলেজ অব হোম ইকোনোমিকসের রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ও অন্টারপ্রেনিওরশিপ বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তাহমিনা কবীর। দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন ৪ বছর যাবত। ডলি’স একটি পাটজাত পণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান। হারিয়ে যাওয়া,ঐতিহ্যে ম্লান হয়ে যাওয়া পাটকে আবার সোনালী করে তোলার জন্য ডলি’স কাজ করে যাচ্ছে । অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন তাহমিনা। পরিবারে ৬ বোন এক ভাই। বাবা মারা যান ২০০৩ সালে। তাই স্বাভাবিকভাবেই অনার্সে এসে নিজের দায়িত্ব নেওয়াটাকে কর্তব্য মনে করেছিলেন। বাধ্যবাধকতা ছিলনা উপার্জন করার কিন্তু নিজের ভিতর থেকে এটা বোধ করেছিলেন। কিন্তু টিউশনে নিয়ম করে প্রতিদিন যাওয়াটাও ছিল কষ্টসাধ্য। একটু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করতেন ছোটবেলা থেকেই, যা টিউশন করে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। মন ছিল না এই পেশায়।
ছোট থেকে স্কুল কলেজের প্যারেড লিডার হওয়ায় লিড দেওয়ার একটা মনোভাব ছিল।পরিবারের সবাই প্রতিষ্ঠিত, এটাও একটা তাড়না ছিল তাহমিনাকেও কিছু একটা করতে হবে। তাহমিনার বাবাকে তার উপজেলায় সবাই এক নামে চিনতেন, ছোট থেকে এটা দেখেই বড় হয়েছেন তাই সহজাতভাবে তার ভিতরেও এটিই কাজ করতো, সবাই তাকেও চিনবে তার আব্বার মত। ছোট থেকে ক্রাফটিং এর প্রতি আকর্ষণ ছিল আর পড়াশোনা করছিলেন রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এন্ড অন্টারপ্রেনিওরশিপ বিভাগে। ভেতরের সম্ভাবনাটা দেখে দুলাভাই শাহ পরান উৎসাহ দেন কিছু করার। স্বপ্নটা তখনি বোনা শুরু হয়। দুলাভাই কিছু ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থাও করে দেন ক্রাফটিং এ। ডলিজের নাম লোগো তৈরি করে দেন নিজেই।
এরমধ্যে তাহমিনার দেখা হয় Bangladesh youth enterprise advice & help centre BYEAH এর সাথে। তাদের সাথে জার্নিটাই ছিল তার টার্নিং পয়েন্ট। তাহমিনার মাঝের সুপ্ত উদ্যোক্তাকে যেন ঝকঝকে আয়নার সামনে তারা স্পষ্ট দেখিয়ে দিলেন। বিভিন্ন ট্রেনিং, ওয়ার্কশপের পর তাহমিনা খুঁজে পেলেন তার ট্র্যাক। পাটকেই করলেন নিজের স্বকীয়তার অংশ। তখন থেকে শুরু পাট নিয়ে জানাশোনা। বিইয়ার মেন্টরশিপ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় পাট পন্য তৈরির ট্রেনিং এর সুযোগ এলো জেডিপিসিতে। এরপর যেন শুরু আবার নতুন করে। থেমে থাকার সুযোগ নেই আর। পাট নিয়ে কাজ করতে যেয়ে নিজেই কখন “পাটকন্যা” উপাধি পেলেন তা ঠাউর করাটাও মুশকিল বটে! নিজেকে আজকাল পাটের মানুষ ভাবতে খুব ভাল লাগে সব সময়।
কাজের স্বীকৃতি ও সম্মাননা প্রাপ্তিতে তাহমিনা কবির জানান, “আজকের অনুভূতি সত্যিই প্রকাশ করার মত না। আব্বা না থাকায় আমাদের সব ভাইবোনকেই অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই নিজেদের জায়গা তৈরি করতে হয়েছে। নিজের উপজেলা থেকে এমন সম্মাননা পাওয়া মানে কাজের দায়িত্ব আরো বেড়ে যাওয়া। আব্বার মেয়ে হিসেবে নিজেকে আবার দেখা। আমি চাই আমার মাধ্যমেই আবার কটিয়াদি উপজেলায় আমার আব্বাকে মনে রাখুক সবাই। ছোট বয়সেও যে সম্মান আর ভালবাসা আমি পেয়েছি তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
সাদিয়া সূচনা