কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জে অরোভি রহমানের জন্ম। বাবা মৃত মোখলেছুর রহমান ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা মৃত আফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিনী। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট অরোভি। জন্মের পর থেকেই অনেক প্রতিকূলতার মাঝে তাকে বড় হতে হয়েছে। আর দশ জনের মতো তার জীবন এতো সহজ ছিল না।
অরোভি রহমান একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। আর সে কারণে ছোটবেলা থেকেই ভাইবোন তাকে পছন্দ করতো না। মা-বাবা তাকে অনেক ভালোবাসতেন, তার জন্য খুব কষ্ট পেতেন।
অরোভি রহমান বলেন: আমার পরিবারের সবাই পড়াশোনা করেছে, বড় ভাই আর্মিতে চাকরি করতেন। তাই মা বাবা দুজনের অনেক স্বপ্ন ছিল আমিও অনেক লেখাপড়া করব, অনেক বড় হবো, নিজে কিছু করবো। আমি তাদের স্বপ্ন পূরণ করতেই একজন উদ্যোক্তা হয়েছি।
কুমিল্লার মির্জাপুর সাত পুকুরিয়া হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন অরোভি। তৃতীয় লিঙ্গ হয়ে জন্ম নেওয়াতে প্রাইমারি থেকে হাই স্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা করতে অরোভি রহমান অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তারপরও গ্রাম থেকে শহরে এসে টঙ্গী সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। এখন তার ইচ্ছে এলএলবি ডিগ্রি নেওয়া।
অরোভি রহমানের প্রতিষ্ঠানের নাম “অরোভি কুটির শিল্প মেলা”। বিভিন্ন রকমের শাড়ি, নকশিকাঁথা, কটি, থ্রি পিস, ওয়ান পিসসহ নানা হাতের কাজের পণ্য তিনি তৈরি করেন। সুঁই সুতার কাজ দিয়ে শুরু করলেও অরোভি এখন ব্লকপ্রিন্ট ও হ্যান্ডপ্রিন্টের পণ্য নিয়েও কাজ করছেন। বঙ্গগড়া ফাউন্ডেশন ও সাদা কালো প্রতিষ্ঠানেও অরোভির হাতের কাজের পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে।
শুরু প্রসঙ্গে অরোভি বলেন: শুরুটা অনেক কষ্টের ছিল। নিজের ভাইই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে মা আমাকে ঢাকা শহরে পালিয়ে আসতে সাহায্য করেছিলেন। ঢাকা আসার পর নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে নিজের জমানো মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে উদ্যোগ শুরু করেছিলাম। ছোটবেলা থেকেই সুইঁ সুতার কাজ করতে আমার খুব ভালো লাগতো। আমি তৃতীয় লিঙ্গের হলেও রাস্তায় ঘুরে টাকা তোলা কখনই পছন্দ করতাম না। তৃতীয় লিঙ্গ মানেই শুধু রাস্তায় ঘুরে টাকা তোলা না। আমি সব সময়ই চেয়েছি নিজে স্বাবলম্বী হবো, নিজে কিছু করবো। সেই চিন্তা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়া।
‘শুরুতে আমি একটা দোকানে বসে সুঁই সুতা দিয়ে কাজ করতাম। মানুষ আমার কাজ পছন্দ করতো। একটা আপুর শাড়ি দিয়ে আমার হাতের কাজের সূচনা। ঐ আপুর একটা শাড়িতে ডিজাইন করে দিয়েছিলাম, তিনি আমাকে পাচঁশ টাকা মজুরি দিয়ে ছিলেন। আমাকে তিনি তার বোনের মতো দেখতেন, সব সময় আমার খোঁজ খবর নিতেন। বিভিন্ন কাষ্টমারও আমার কাছে পাঠাতেন। উনি আজ দুনিয়াতে নেই, কিন্তু আমি তার কাছে সব সময় ঋণী। আমার জীবনের ধারা তিনিই পাল্টে দিয়েছিলেন। আরো কিছু মানুষের কাছেও আমি ঋণী যারা আমাকে স্বাবলম্বী হতে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন,’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নকশীকাঁথা নিয়ে যখন অরোভি কাজ শুরু করেন তখন তার কাছে কোন পুঁজি ছিল না। মানুষের থেকে অর্ডার নিয়ে তিনি কাজ করতেন। এভাবে আস্তে আস্তে নকশীকাঁথা থেকে শাড়িসহ অন্য জিনিসেরও অর্ডার পেতে শুরু করেন। তার নিজস্ব কোন কারখানা বা শো রুম নেই, ঘরোয়া ভাবেই তিনি ব্যবসা করছেন। বতর্মানে নিজস্ব ব্যবসা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্ডার বাবদ তার আয় হয় মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার।
অরোভি বলেন: সুঁই সুতার কাজটা আমার রক্তের সাথে মিশে গিয়েছে। এটার প্রতি আমার অনেক ভালোবাসা, বিভিন্ন কর্মী দিয়ে কাজ করালেও আমি নিজেই অনেক পণ্যের কাজ করে থাকি। এতেই আমি শান্তি পাই।
তার প্রতিটা পণ্যের নকশা ও ডিজাইন নিজেই করে থাকেন। তারপর সেগুলো বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলের অসহায় নারী, প্রতিবন্ধী ও হিজরা জনগোষ্ঠী দিয়ে হাতের কাজ করিয়ে থাকেন।
তরুণদের উদ্দেশে অরোভি বলেন: বতর্মান সময়ে সবাই শহরমুখী হতে চায়। কিন্তু শহরমুখী না হয়ে নিজ নিজ জেলায় থেকেও তরুণরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে পারেন। চাকরির পেছনে না ছুটে, যার যে বিষয়ে আইডিয়া আছে তাই নিয়েই কিছু করার চেষ্টা করা উচিত। যেমন কেউ জমিতে ফসল ফলাতে পারেন, কেউ হাঁস মুরগি পালতে পারেন, কেউবা আবার মাছের চাষও করতে পারেন।
অরোভি মনে করেন, উদ্যোক্তা হওয়া এতো সহজ না, আবার কঠিনও না। কোনো কাজকে ছোট মনে না করে পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অরোভি বলেন: আসলে আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। বতর্মান নিয়েই ভাবতে ভালোবাসি। তারপরও ভবিষ্যতে নিজে সুইং ও ব্লকপ্রিন্টের একটা কারখানা দিতে চাই, সেজন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছি। এছাড়া আমার প্রতিষ্ঠানে আমি সব ধরনের মানুষকে কাজ করার সুযোগ দিতে চাই। আমাকে মানুষ সুযোগ দেয়নি কিন্তু আমি সবাইকে কাজ করার সুযোগ দিতে চাই।
আফসানা অভি
উদ্যোক্তা বার্তা