উদ্যোক্তা অঙ্কিতি বোস

ভারতে মহিলা উদ্যোক্তা খুব কমই আছেন, তার ওপর আবার বাঙালি। এই হাতে গোনা বাঙালি মহিলা উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম অঙ্কিতি বোস।

ভারতের বিভিন্ন শহরে বেড়ে ওঠা অঙ্কিতি বর্তমানে কর্মসূত্রে থাকেন সিঙ্গাপুরে। ২০১৫ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ই-কমার্স সাইট খুলেছিলেন অঙ্কিতি, নাম জিলিঙ্গো। পরে বিজনেস-টু-বিজনেস প্ল্যাটফর্মও শুরু করেছে জিলিঙ্গো, আর তাতেই মাত্র চার বছরে, সেই ব্যবসার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। মাত্র ২৭ বছর বয়সী অঙ্কিতিই প্রথম ভারতীয় মহিলা উদ্যোক্তা যার ব্যবসার মূল্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।

২০১৪ সালে ব্যাংককে কিছু প্রাক্তন সহকর্মীর সঙ্গে ঘুরতে যান অঙ্কিতি। সেখানেই বন্ধুদের সঙ্গে সপ্তাহের চাতুচক (Chatuchak) বাজারে কেনাকাটা করছিলেন। চাতুচক বিশ্বের বৃহত্তম সাপ্তাহিক বাজার, রয়েছে ১৫ হাজারের বেশি দোকান, ব্যবসা করেন ১১ হাজার ৫৫০ এর বেশি ব্যবসায়ী। সেখানে গিয়েই অঙ্কিতির মনে হয় এই পুরো বিষয়টাকে যদি অনলাইনে নিয়ে যাওয়া যেত তাহলে এই ব্যবসায়ীরা কত বেশি লাভ করতে পারতেন, টেক্কা দিতে পারতেন নামীদামী ব্র্যান্ডকে। ভাবনার শুরু সেখান থেকেই।

উদ্যোক্তা-অঙ্কিতি বোস এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও মুখ্য প্রযুক্তি অফিসার ধ্রুব

অঙ্কিতি অঙ্ক ও অর্থনীতি স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করেছেন মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। অঙ্কিতির বাবা একটি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব তেল কোম্পানির কর্মী, মা সন্তানকে বড় করার জন্য কলেজে পড়ানোর চাকরি ছেড়ে দেন। বাবার চাকরি সূত্রে অঙ্কিতির ছোটবেলা কেটেছে বিভিন্ন শহরে, পরিচিত হয়েছেন নানা সংস্কৃতির সঙ্গে।

পড়াশোনা শেষ করে ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে অঙ্কিতি যোগ দেন ম্যাকিনসে এন্ড কোম্পানিতে (McKinsey & Company)। এর কিছু দিনের মধ্যেই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি সেক্যুইয়া ক্যাপিটালের বেঙ্গালুরু অফিসে একজন অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন অঙ্কিতি, কাজ করতেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা কোম্পানিদের সঙ্গে।

সেই সময়েই আমেরিকার অ্যামাজন, চীনের আলিবাবা বা ভারতের ফ্লিপকার্টের মতো কোম্পানীগুলোর উত্থান লক্ষ্য করছিলেন অঙ্কিতি। চাতুচক বাজার ও নিজের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজার সম্পর্কে জ্ঞান থেকে অঙ্কিতি বুঝতে পারেন এই অঞ্চলের ছোট ব্যবসায়ীরা তখনও এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম উৎপাদকগুলোর মধ্যে একটি, কিন্তু তা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে পিছিয়ে পড়ছেন এই ব্যবসায়ীরা। জিনিস বিক্রির জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের ওপর।

অঙ্কিতি ঠিক করেন এই স্বাধীন ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু একটা করতে হবে, যাতে তারা সরাসরি ক্রেতাকে অনলাইনে জিনিস বিক্রি করতে পারে। কিন্তু অঙ্কিতি জানতেন, এই উদ্যোগ শুরু করতে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার যা তার নিজের জ্ঞানের পরিধির বাইরে।

ব্যাংকক থেকে ফেরার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ২৪ বছর বয়সী সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ধ্রুব কাপুরের সঙ্গে। একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে অঙ্কিতির বেঙ্গালুরুর ফ্ল্যাটে একটি হাউজ পার্টিতে আসেন ধ্রুব। আড্ডাচ্ছলেই নিজের ভাবনার কথা জানান অঙ্কিতি, মত জানতে চান ধ্রুবের। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান ধ্রুব। বর্তমানে জিলিঙ্গোর সহ প্রতিষ্ঠাতা ও মুখ্য প্রযুক্তি অফিসার ধ্রুব।

প্রথম সাক্ষাতের ছ’মাসের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দেন অঙ্কিতি ও ধ্রুব, জড়ো করেন নিজেদের জমানো টাকা। দু’জনেই দেন ৩০ হাজার মার্কিনি ডলার করে। রাজি করান কিছু বন্ধুদেরও যারা চাকরি ছেড়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন।

২০১৫ সালে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ শুরু করে জিলিঙ্গো। শুরুতে সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ঘুরে খুচরো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেন অঙ্কিতি, তাদের বোঝান জিলিঙ্গোতে জিনিস বিক্রি করে তারা কীভাবে লাভ করতে পারবেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময়েই অঙ্কিতি বুঝতে পারেন শুধুমাত্র জিনিস বিক্রিই হয়, এমন একটি প্ল্যাটফর্ম বানাতে হবে, বিন্দুমাত্র প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকলেও যা ব্যবহার করা যাবে। ধ্রুব এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন যেটি ব্যবহার করা ফেসবুকের মতোই সহজ।

সিঙ্গাপুর ও বেঙ্গালুরুতে অফিস করে কাজ শুরু করে জিলিঙ্গো। অভূতপূর্ব সাড়া মেলে খুচরো ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের থেকে। জিলিঙ্গোতে পণ্যের যাবতীয় তথ্য আপলোড করতে হয় বিক্রেতাকে। এরপর জিলিঙ্গোর পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখে তা অনুমোদন করা হলে তবেই ক্রেতা তা দেখতে পান। প্রতি বিক্রিতে ১০-২০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে হয় জিলিঙ্গোকে।

ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করতে করতে অঙ্কিতি ও ধ্রুব বুঝতে পারেন এই ব্যবসায়ীদের প্রযুক্তি ও পুঁজির ক্ষেত্রে সাহায্যের প্রয়োজন, সাহায্য প্রয়োজন কাঁচামাল যোগানের ক্ষেত্রে। এই নতুন ক্ষেত্রটিতে কাজ করতে ২০১৬ সাল থেকে নিজেদের বিজনেস-টু-বিজনেস প্ল্যাটফর্ম শুরু করে জিলিঙ্গো। সেই বছর থেকেই পাকাপাকিভাবে সিঙ্গাপুরে থাকতে শুরু করেন অঙ্কিতি।

সফট্ওয়্যার ও টুলগুলো ব্যবহারের জন্য ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে জিলিঙ্গো। নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ত করার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের থেকেও ব্যাপক সাড়া মিলেছে। পুঁজি ছাড়াও জিলিঙ্গো দেখে যাতে ব্যবসায়ী স্বাস্থ্যবিমা ও স্কলারশিপের সুযোগ পান। ইন্দোনেশিয়াতে তারা ২০০ জন ব্যবসায়ীকে ইংরেজি শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দিয়ে থাকে।

কোম্পানির বক্তব্য অনুযায়ী বর্তমানে তাদের আয়ের মূল উৎস এই বিজনেস-টু-বিজনেস প্ল্যাটফর্ম। লাভ হচ্ছে ছোট খুচরো ব্যবসায়ী ও উৎপাদনমুখী কোম্পানিদেরও।

২০১৫ সালে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বাজারে উপস্থিতি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল জিলিঙ্গো। বর্তমানে আটটি দেশে অফিস রয়েছে এই কোম্পানির, কর্মী সংখ্যা ৪০০। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিনস্, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, হংকং সহ মোট ১৪টি দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করে জিলিঙ্গো। ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি। এই কোম্পানিগুলোর কর্মী সংখ্যা মোটামুটি ৪ লাখ ৫০ হাজার যার মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশিই মহিলা কর্মী।

নিজের শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়মিতভাবে নতুন মহিলা উদ্যোক্তাদের মেন্টরের কাজ করেন অঙ্কিতি। অঙ্কিতির মতে, আমাদের সমাজে নারীবিদ্বেষ এতটাই ভিতরে শিকড় গেঁথে রয়েছে যে মহিলারা প্রায়শই নিজেদের মূল্য ও ক্ষমতা বুঝতে পারেন না। এমনকি তার নিজের কোম্পানিতে যে মহিলা কর্মীরা রয়েছেন তারাও তাদের দক্ষতা ও মেধা অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধির অনুরোধ জানাতে দ্বিধা বোধ করেন।

অঙ্কিতিকেই বোঝাতে হয় তারা আসলে আরো বেশি বেতন পাওয়ার যোগ্য। অঙ্কিতি মনে করেন, মহিলা উদ্যোক্তাদের মধ্যে অসীম ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তারা সে কথা বুঝতে পারেন না এবং উন্নত দেশ নিউইয়র্ক ও পিছিয়ে থাকা দেশ জাকার্তা- সব জায়গাতেই মহিলাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। ছোট ব্যবসায়ীদের সাহায্য করার পাশাপাশি মহিলা উদ্যোক্তাদের আরো সামনে নিয়ে আসাই এখন লক্ষ্য অঙ্কিতির।

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here