কেন্ড্রা স্কট

বহু মিলিয়ন ডলারের গয়না ডিজাইন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং একজন সক্রিয় জনহিতকর কর্মকর্তা হিসেবে কেন্ড্রা স্কটের কাজ কখনো থামেনি। কিন্তু আপনি যখন এই ব্যস্ত মহিলার কাছে জানতে চাইবেন, আপনি নিজেকে কিভাবে বর্ণনা করেন-তখন সে বলবে, “আমি প্রথম একজন মা”
আমি এমন একটি সংস্থা তৈরি করেছি যা আমাকে মা হতে দেয় এবং এটিই আমার প্রথম অগ্রাধিকার ছিল।

কেন্ড্রা স্কট ডিজাইনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হলেও, তিনি একজন সফল “Mompreneur”। ইনভেস্টোপিডিয়া অনুসারে, এটি এমন একটি নতুন শব্দ যা নারীদের বর্ণনা করে, যারা তাদের নিজস্ব ব্যবসা চালায় এবং একইসাথে পিতামাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মমপ্রেনিউর কেন্ড্রা স্কট

১৯৭৪ সালের ২৭মার্চ উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে জন্ম নেওয়া কেন্ড্রা স্কটের শৈশব কাটে ওখানেই। ১৮ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে টেক্সাসে যান। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিতে হয়। ঠাঁই মেলে টেক্সাসের অস্টিনে। প্রায় ১০ বছর ধরে ব্যবসা করেন তিনি। ক্যানসারে আক্রান্ত নারী যাদের কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের জন্য আরামদায়ক টুপি বা হ্যাট তৈরি করতেন। লাভের কিছু অংশ তিনি স্থানীয় হাসপাতালে দান করে দিতেন।

১৯৯৮ সাল, তিনি তার জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়ে ফেলেছিলেন, এবং তার বাপ-দাদাদের মধ্যে, যার ক্যান্সারের যুদ্ধ তাকে অস্টিন, টেক্সাসে শুরু করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

২৪ মার্চ স্কট শেষ- বিশ্বাস করে যে আশ্চর্যজনক মুহূর্ত একটি কারনে ঘটেছে। “আপনি যদি আপনার জীবনের সংগ্রামের দিকে তাকান, বুঝতে পারবেন সব ঘটেছে কারণ আপনার জন্য অসাধারণ কিছু অপেক্ষা করছে।একটি খোলা উইন্ডো আছে।এই মুহুর্ত ভবিষ্যতে আপনাকে শক্তিশালী করতে যাচ্ছে।

এরই মাঝে বিয়ে হয়ে যায় স্কটের, অন্তঃসত্ত্বা কেন্ড্রা স্কটের স্বামী বেকার, ঘরেই বসে থাকতেন, কোনো কাজে কর্মে মন ছিল না তাঁর। নতুন মা হবেন, এই আনন্দকে ছাপিয়ে ভবিষ্যতের শঙ্কায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটে স্কটের। ২৮ বছরের স্কট যেন শুয়ে থেকেও শান্তি পাচ্ছিলেন না। যুক্তরাজ্যের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অস্টিনে নিজের ছোট্ট বাসার বিছানায় শুয়ে শুয়ে গয়নার নকশা আঁকেন। ওই নকশায় তৈরি করতেন কানের দুল। জন্ম নিল তার প্রথম সন্তান। বুঝতে পারছিলেন কিছু করতেই হবে তাঁকে। কয়েক দিন বয়সের ছেলেকে বুকের সঙ্গে বেঁধে কাজে লেগে পড়েন স্কট। সঞ্চয় বলতে মাত্র ৫০০ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৪০ হাজার টাকা) নিজের উপর বাজি ধরেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন কেন্ড্রা স্কট

সে সময় বাজারে দুই ধরনের গয়না পাওয়া যেত। ভালো মানের খুব দামি গয়না, আর খুবই নিম্নমানের সস্তা গয়না । দাম ও মানের এই ব্যবধানে সকল শ্রেনীর চাহিদা পূরণে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। চৌকস কেন্ড্রা এ অবস্থা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারেন। শুরু করেন গয়না তৈরির ব্যবসা। চিন্তা করেন ভালো মানের তবে সাশ্রয়ী মূল্যে গয়না তৈরি করবেন। তার মতে, ‘অর্থনৈতিক অবস্থা যা-ই থাকুক না, প্রতিটি নারীই খুব আত্মপ্রত্যয়ী ও সুন্দর হতে চান’।

বাড়ির অতিরিক্ত বেডরুমের বাইরে সেন্টার স্কট ডিজাইন তৈরি করেন।
স্কট বলেন, “আমি আপনাকে বলিনি যে কতবার আমাকে বলা হয়েছিল ‘না’।আমি আপনাকে বলতে পারছি না কতবার কতবার লোকেরা আমাকে বলেছিল তুমি এটা তৈরি করতে পারবেনা।সেখানে অনেক গয়না ডিজাইনার আছে”।

২০০২ সাল, অস্টিনের বিভিন্ন বুটিকের দোকানে নিজের ডিজাইনের দুল বিক্রি করেন। প্রথম দিনেই সাফল্য। সব দুল বিক্রি হয়ে যায়। তারপর পাইকারি হারে বিক্রি করতেন। বিভিন্ন দোকানে পণ্য জোগান দিতেন।ব্যবসায় নেমে তাড়াহুড়া করেননি স্কট। তাঁর প্রতিষ্ঠান কেন্ড্রা স্কট ডিজাইন গড়ে তোলেন বেশ ধীরে ধীরে। ৪৪ বছরের স্কটের জীবন এখন অন্য রকম। সাফল্যে ঝলমল করছেন, ঢুকেছেন শত কোটিপতির ঘরেও। ফ্যাশন জগতে একনামে সবাই চেনে ‘কেন্ড্রা স্কট ডিজাইন’ কোম্পানির নাম। মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের ২০১৭ সালের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬তম ধনী নারী কেন্ড্রা। তাঁর এই সাফল্য অন্যদের চেয়ে অনেক আলাদা। পুরোপুরি নিজের চেষ্টায় এত দূর এসেছেন কেন্ড্রা।

নিজ কালার ল্যাবে কেন্ড্রা স্কট

সফল মানুষের তালিকায় কিন্তু খুব সহজে আসেননি স্কট। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়,দুই সন্তান নিয়ে এক রকম যুদ্ধ করেই এগিয়েছেন তিনি।

২০১০ সালে অস্টিনে প্রথম স্টোর খোলেন স্কট। অসাধারণ ওই মুহূর্তের কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘নিজের তৈরি গয়না দিয়ে প্রচলিত ধারণা পাল্টাতে চেয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ গয়নার দোকানগুলো খুব বেশি আনুষ্ঠানিক ধরনের। ভেলভেটের কাপড়ে মোড়া ও বাক্সে আটকানো গয়না দেখতে কেমন ভয় পান সাধারণেরা। আমি চেয়েছিলাম এমন একটি উষ্ণ পরিবেশ তৈরি করতে, যেখানে সবাই সাবলীল থাকবে আর আনন্দপূর্ণ পরিবেশ থাকবে।’ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সবাই লুফে নিয়েছে স্কটের ডিজাইন, নিজস্ব ঢং।

বিশ্ব ব্র্যান্ড কেন্ড্রা স্কট

জুয়েলারী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন,স্কটের সাফল্যের পেছনে মূল চাবি কাঠি হলো ‘বাস্তব চুক্তি’। তিনি নিজের অবস্থা থেকে উঠে আসতে দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন। নেইম্যান মার্কাসের ফ্যাশন ডিরেক্টর কেন ডাওনিং বলেন, ‘তাঁর নিজস্ব গয়নাগুলোতে গ্রাহকেরা সেটাই পায়, যেটা তারা চায়। স্কট যা করেছে, তা হলো তাঁর তৈরি গয়নার মধ্যে একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি দিয়েছে। দামও এমন যা গ্রাহককে সন্তুষ্টির অনুভূতি দেয়।’

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তাঁর কোম্পানির ৯৪টি স্টোর আছে। ২০০০ জন এরও বেশী কর্মী আছেন, যার মধ্যে ৯৬ শতাংশই নারী। এমনকি অনলাইনেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয় তাঁর গয়না। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার থাকলেও সিংহভাগ শেয়ার রয়েছে স্কটের হাতেই।

এক্সিবিশনে কেন্ড্রা স্কট

স্কটের শক্তি সাত কর্মী, যারা শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গে ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই নারী। এখনো আছেন তার পাশে।কর্মী হিসেবে অসম্ভব ভালো কিছু মানুষকে পেয়েছিলেন তবলেই এত বড় প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন। কারন পথচলাটা শুরু হয় পুরোপুরি একা। ‘আমি চেয়েছিলাম, মেধাবী একদল মানুষকে জড়ো করতে, যারা আমাকে ব্যবসা দাঁড়া করাতে সাহায্য করবে’—এভাবেই কর্মীদের কথা বলেন তিনি। স্কট তার কর্মীদের নাচ,আবৃত্তি এবং ফুটবল গেমসে উৎসাহিত করেন।কর্মীরা তাদের কাজের প্রশংসা করেন।
Workingmother.com অনুযায়ী কাজের মায়েদের জন্য শীর্ষ পছন্দগুলি তাদের সময়সূচীতে নমনীয়তা অন্তর্ভূক্ত করে।
যে সুবিধাগুলি স্কট তার কর্মীদের দেয় সে অনুযায়ী অস্টিন বিজনেস জার্নাল সম্প্রতি তার প্রতিষ্ঠানকে “কাজ করার সেরা স্থানগুলির” একটিতে ভূষিত করেছেন।

 

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

জান্নাতুল ফেরদৌস তিথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here