উদ্যোক্তা ড. জিনিয়া রহমান

ঘুরে বেড়ানোর নেশা আমাদের রক্তে। আর তাই সময়-সুযোগ পেলেই ঘুরতে চলে যাই কোথাও না কোথাও। ঘুরতে গিয়েই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি ঘুরে বেড়ানোর উপযোগী আরামদায়ক কাপড়, ব্যাগ বা জুতার। আর তখনই কয়েক বছরের পুরানো রোমাঞ্চ বিষয়ক পেজের সব একটিভিটির পাশাপাশি একটা অনলাইন অ্যাডভেঞ্চার গিয়ার শপের উদ্যোগ নেই।

‘পালং খ্যিয়ং’ সোশ্যাল মিডিয়া পেজে পাওয়া যাচ্ছে হাতে-বোনা মনিপুরি শারী ও অন্যান্য জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি ছাড়াও কাঠের ব্লকের শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবি। সেই সঙ্গে টাঙ্গাইলের তাঁত, খাদি, খেশ সবই পাওয়া যায় এখানে। তবে মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশীয় পোশাকের দিকে।

উদ্যোক্তা ড. জিনিয়া রহমান উদ্যোগের গল্পের শুরুতে বলেন, প্রথমে আমরা শুরু করি বাংলাদেশের পতাকার থিমে কুইক ড্রাই টি-শার্ট দিয়ে। এরপর সেই ধারাবাহিকতায় আসে আরো কিছু টি-শার্ট, কুইক ড্রাই প্যান্ট, হ্যামক, রেইন পঞ্চ, ব্যাগ ইত্যাদি।

উদ্যোক্তা জিনিয়া বলেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের আলো বাতাসে আশ্চর্য সুন্দর শৈশব কেটেছে। জাপানে পিএইচডি শেষে পোস্ট ডক করতে যাই সুইডেনে। দেশের টানে ফিরে এসে শিক্ষকতায় যোগদান করি। ছাত্র পড়ানো, পরীক্ষা নেওয়া আর রেজাল্ট দেওয়া। এ ছাড়াও হাজার রকম প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক ব্যস্ততা এবং গবেষণা কার্যক্রমে বেশ ব্যস্ত সময় কেটে যায়। আরেকজন উদ্যোক্তা অপুর জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা কর্ণফুলী নদীর্ পাড়ে রাঙ্গুনিয়া। চট্টগ্রামে ঘুরে বেড়ানো, গান গাওয়া আর ছবি তোলা প্যাশন তার। এগুলো নিয়েই আছেন উদ্যোক্তা।

উদ্যোক্তা গল্পের শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে জিনিয়া বলেন, ২০১০ সালে অ্যাডভেঞ্চার এক্টিভিটির গ্রুপ হিসেবে যাত্রা শুরু করে লিভিং উইথ ফরেস্ট। ভ্রমণপিপাসু এক দল ছেলে-মেয়ের নিজস্ব জায়গা হলো লিভিং উইথ ফরেস্ট। এরা পাহাড়ে-পর্বতে, বনে বাদারে, নদী-সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। কোন পাহাড় কতটা উঁচু, কিভাবে যাওয়া যায় চূড়ায়, কোথায় কোন পাহাড়ের খাঁজে ঝর্ণা লুকিয়ে আছে, কোথায় গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ধনেশ পাখি, সরল আদিবাসীদের অকৃত্রিম জীবনযাত্রা কেমন এই সব দেখে বেড়ানোই ছিলো এই গ্রুপের কাজ। শুধু ঘুরে বেড়ানোই না, যেহেতু এরা প্রকৃতিপ্রেমি তাই ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি বৃক্ষ রোপণ, ট্যুরিস্ট স্পটগুলো আবর্জনামুক্ত রাখা ইত্যাদি নানা সচেতনাতামূলক কাজও গ্রুপ থেকে হতো। ২০১৫ সালে গ্রুপের এডমিন কালপুরুষ অপুর জীবনে ভীষণ দুঃখজনক এক ঘটনা ঘটে। তার সাড়ে চার বছরের ছেলে ক্যাসপার দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যায়। এরপরে বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকে গ্রুপের আক্টিভিটি।

২০১৭ সালে আমি আবার হাল ধরি এই গ্রুপের। অল্প অল্প করে ছোট ছোট অ্যাক্টিভিটি শুরু করি। এরপরে এটাকে আরো সমৃদ্ধ রূপ দিতে আমরা লিভিং উইথ ফরেস্টের ওয়েবসাইট তৈরি করি। কয়েক মাস এই ওয়েবসাইটের ওপর কাজ করে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি আমরা শুরু করি একটা পরিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার পোর্টাল হিসেবে। তখনই প্ল্যান ছিলো এই পোর্টালের সঙ্গে আমরা অনলাইন শপ যুক্ত করবো। কারণ আমাদের দেশে নানা অ্যাডভেঞ্চার আক্টিভিটিতে যেসব জিনিসপত্র লাগে সেগুলো সহজলভ্য নয়। বেশির ভাগ জিনিসই দেশের বাইরে থেকে আসে এবং আমাদের বেশ চড়া দামে সেগুলো কিনতে হয়। অথচ অনেক নামকরা ব্রান্ড নর্থ ফেস, ডিকাথলন বা কলম্বিয়ার প্রোডাক্টের ফ্যাক্টরি আমাদের দেশেই। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ২০১৮ সালে ক্যাসপারের জন্মদিনে বাংলাদেশের পতাকার কনসেপ্টের টি-শার্ট বানিয়ে শুরু হয় আমাদের লিভিং উইথ ফরেস্টের অনলাইন শপের যাত্রা। ক্যাসপারের নামকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা টিশার্টের নাম দিলাম ক্যাসপার এবং ঠিক করলাম এই টিশার্ট থেকে আয়ের একটা অংশ ব্যয় হবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের চিকিৎসার জন্য। এরপর ধীরে ধীরে আমাদের নিজস্ব ডিজাইনের আরো টিশার্ট তৈরি করেছি, সেই সঙ্গে আছে হ্যামক, রেইন কাভার, ওয়াটার প্রুফ ব্যাগ কাভার, স্লিপিং ব্যাগ, পোর্টেবল চুলাসহ আরো নানা পণ্য। কোয়ালিটির সঙ্গে কোনোভাবেই আমরা কম্প্রোমাইজ করবোনা, তাই অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস সোর্সিংয়ের অভাবে আমরা রাখতে পারছি না।

উদ্যোক্তা অপু বলেন, ২০১৫ সালে বেশ কিছু দিন অসুস্থতা নিয়ে বিছানা শয্যাশায়ী ছিলাম। সে সময় শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করতাম অনেক। আর দেখতাম নানা অনলাইন পেজের নানা রকম জিনিস। সারাক্ষণ আমার পড়াশুনা গবেষণা ইত্যাদির চিন্তা করতে ইচ্ছা করতো না। ভাবতাম চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে নিজের সখের জন্য কিছু করবো। সেই থেকে আমি গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শুরু করেছিলাম। প্রচুর পড়তাম নানা উদ্যোগ, ব্যবসার খুঁটিনাটি, সোর্সিং নিয়ে।

তারা আরো বলেন, দেশী কাপড় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা অনেক পুরানো হলেও পরিকল্পনা, সময় কোনো মিলছিলো না। আর তাই ওসবে তোয়াক্কা না করে হঠাৎ করেই শুরু করে দিলাম প্রিয় ঝর্ণা ‘পালং খ্যিয়ং’র নামে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পেজ। পালং খ্যিয়ং অনিন্দ সুন্দর এক পাহাড়ি জলপ্রপাত। সবুজের আঁচল ছড়িয়ে রুপালী জলের শাড়িতে জড়ানো পালং খ্যিয়ং নামের মায়াময় সুন্দর জলপ্রপাতটার ঠিক পায়ের কাছে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দই বারবার ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো ‘নারী’। বন-পাহাড়ের অবগুন্ঠনকে উপেক্ষা করে প্রবল স্বকীয়তায় ভাস্বর পালং খ্যিয়ং, ঠিক যেন কোনও স্বাধীন, স্বপ্রতিভ মানবীর নিখুত প্রতিরুপ! ভাবনার ঘূর্ণির অতলে তলিয়ে যেতে যেতেই মনে হলো, নারীদের নিয়ে কিংবা নারীদের জন্য যদি কখনও কোনও কিছু করি তার নাম রাখবো ‘পালং খ্যিয়ং’। পেজের এই নাম দেওয়ার কারণ শাড়িগুলোকে আমার মনে হয় ঝর্ণার মত, ঝর্ণার জল যখন আছড়ে পড়ে পায়ের কাছে মনে হয় যেন শাড়ির আঁচল বেয়ে নেমে এসেছে ঝর্ণার স্রোত।

উদ্যোক্তারা দু’জনের গল্পের শেষপ্রান্তে গিয়ে বলেন, একেকটা উদ্যোগের পেছনে যে পরিমাণ পরিকল্পনা, পরিশ্রম, সময় দিতে হয়, নিজের সখ ত্যাগ করাসহ কতো রকমের যে বাধা পেরোতে হয় সেটা কেবল যে করে সেই জানে। কোন কিছুই সহজ নয়, সহজ করে নিতে হয়। আমাদের লিভিং উইথ ফরেস্ট, ক্যাসপার এবং পালং খ্যিয়ং একদিন প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড হবে সেই স্বপ্ন দেখি।

মেহনাজ খান
উদ্যোক্তা বার্তা ঢাকা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here