দুই কন্যা সন্তানের পরিবারে তিনিই বড়। ছোট বেলা থেকেই তার বাবা তাকে ছেলেদের মতো মানুষ করেছেন। খেলার জন্য পুতুলের বদলে ক্রিকেট ব্যাট এবং গ্লাভস কিনে দিতেন। পড়াতেও চেয়েছিলেন প্রকৌশলি বিদ্যাতে। যদিও তা সম্ভব হয়নি। নামের অর্থ “ঢেউ” এর মতোই ছিলেন চঞ্চল। সন্মান প্রথম বর্ষ অধ্যায়নরত অবস্থাতে বিয়ে হয় মাদারীপুরের সন্তান এ্যাড, আসাদুজ্জামান দূর্জয় এর সাথে। যিনি পেশায় একজন আইনজীবী এবং নেশায় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। উদ্যোক্তা হিসেবে পথ চলার শুরুটা হয় তখন থেকেই।
কথা হচ্ছে খুলনার মেয়ে উর্মি রহমানকে নিয়ে। বাবা এম এম হাফিজুর রহমান। যশোর পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি তে কর্মরত আছেন। মা শাপলা রহমান একজন গৃহিণী। এক মাত্র ছোট বোন অদিতি হাফিজ শর্মী। DMRC কলেজে অধ্যায়নরত আছেন।
যদিও খুব ছোটবেলাতেই হাতে খড়ি হয় নিজের নানু আর মায়ের কাছে। নিজের এবং পরিবারের পোশাক ডিজাইন করা। নিজের হাতে গয়না বানিয়ে নিজে পড়া, ফেলে দেওয়া বিভিন্ন কিছু দিয়ে শো-পিস তৈরি করে ঘর সাজানো এসব চলতো হরহামেশাই। স্বামী এবং মায়ের অনুপ্রেরণাতে শুরু করেন খুবই ছোট্ট পরিসরে ই কমার্স বিজনেস। তবে সেটা ছিলো বিদেশী পণ্য নিয়ে।
প্রথমবার বেশ লাভ হলেও ২য় বার পণ্য আনার সময় একটু কম লাভ হয়। তবে সব চেয়ে বড় ধাক্কা খেতে হয় যখন সাপ্লাইয়ার টাকা পেয়ে পণ্য না পাঠিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এবং অন্য সাপ্লাইয়ার মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য পাঠিয়ে ফোন অফ করে রাখেন। উর্মি মহা সংকটে পড়ে গেলেও নৈতিক কারণে একটা পণ্যও সেল করার চেষ্টা করেননি। পুড়িয়ে ফেলেছে সব।
হতাশ হয়ে কিছু দিন অপেক্ষা, তারপর স্বামীর অনুপ্রেরণায় আবার শুরু করেন। এবার কাজ শুরু করেন কিছু ডিজাইনার পোশাক দিয়ে। সেখানেও ঘটে বিপত্তি। ড্রেসের সব পালাজো (সালোয়ার) এমব্রয়ডারি করতে গিয়ে ছোট বড় করে ফেলে সাইজ। এটা একটি না সব গুলো পিসেই একরকম সমস্যা। একটা বিশেষ উৎসবকে উপলক্ষ্য করে পোশাক গুলো ডিজাইন করা হয়েছিলো। এবং তা সংশোধনের সময় ছিলো না। সুতরাং পুনরায় ধস।
২ বার চেষ্টা করে বিশাল আর্থিক লসের স্বীকার হওয়ার পরেও পরিবার তাকে বার বার উৎসাহ দিয়ে গেছেন। কিন্তু এতটাই ক্ষতি হওয়ার পর উদ্যোক্তা সিদ্ধান্ত নেন তিনি এভাবে কাজ করবেন না। যেটা তিনি বোঝেন, জানেন সেটা নিয়ে এগোবেন। শুরু হয় তার দেশী পণ্য নিয়ে “বাঙালি”র যাত্রা। শুরু করে নিজের জমানো মাত্র ২ হাজার টাকা পুঁজি করে। কাঠের, কড়ির, মেটালের গয়না, টিপ, ইত্যাদি দিয়ে পথ চলার শুরু করেন। পরবর্তীতে দেশী তাঁতপণ্য, জামদানী পণ্য, হস্তশিল্প এবং যুগোপযোগী কূর্তি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি যোগ হয় ধীরে ধীরে। খুবই অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে “বাঙালি”।
বর্তমানে অল্প পরিসরে হলেও উৎপাদন করতেও সক্ষম হয়েছেন বিভিন্ন ধরণের পণ্য৷ একেবারে নিজেদের নকশা, নিজেদের লোগো লাগিয়েও তৈরি করছে বিশেষ উৎসবে। সেদিনের ২ হাজার টাকার মুলধন আজ ৫ লক্ষতে গিয়ে ঠেকেছে মাত্র ৮ মাসে। এসএমই আঞ্চলিক মেলা মেহেরপুর এ বাঙালির স্টল ৩য় স্থান দখল করেছে। কিছু দিন আগে শেষ হওয়া জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা ২০২০-এও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন স্ব গৌরবে।
উদ্যোক্তা বলেন, “পরিশ্রম করলে তা ফল দিবেই। একদিন না একদিন অবশ্যই ফল দিবে। একটু ধৈর্য্য রাখতে হবে। হতাশ হওয়া যাবে না। টাকা অবশ্যই দরকার। তবে বুদ্ধি এবং পরিশ্রম থাকলে ক্ষুদ্র পুঁজিকেও বড় করা সম্ভব। এবং পরিবারের সাপোর্ট সবচেয়ে বড় সাপোর্ট। কাজকে ভালবাসতে হবে। কোন কাজ ছোট না। তাহলেই জীবনে কিছু অর্জন করতে পারবেন”।
উদ্যোক্তা আরো বলেন, “আমাদের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন হওয়া উচিত। শুরুর দিকে আমাকে শুনতে হয়েছে ‘নেতার বউ, কাপড় বেচে’। আমার স্বামী সব কাজে আমার সাথে থাকে বলে তাকেও শুনতে হয় এত বড় নেতা কেন এসব সাপোর্ট করেন ইত্যাদি। তাই বলবো মানসিকতা পরিবর্তন করুন। একটু সুযোগ দিন। অবশ্যই কিছু করা সম্ভব”।
উর্মী রহমান এর “বাঙালি” এখনো শুধু মাত্র অনলাইন ভিত্তিক। তবুও তারা উৎপাদন করছেন নানান পণ্য এবং পাইকারিও সেল করছেন। “নারী উদ্যোক্তার খোঁজে” (IS OF WE) নামে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি গ্রুপ পরিচালনা করছেন শুধুমাত্র নারীদের জন্য। যেখান থেকে তিনি একজন নারীর উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের সকল তথ্য দিচ্ছেন হোলসেলার লিস্টের মাধ্যমে৷ পাশাপাশি সেই সকল উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা জোরদার করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন নিজে যদি এক পা এগিয়ে আসেন তাহলে তার হাত ধরে আরও একজনকে হলেও সামনে নিয়ে যাবেন।
বিপ্লব আহসান