বিজনেসের টাকায়ই বিজনেস চলে

0
উদ্যোক্তা রওশন আরা রেখা

বাবার অবর্তমানে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার তাগিদ থেকেই রওশন আরা রেখা একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। জীবনের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, অনেক সীমাবদ্ধতাকে জয় করে স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন রওশন আরা রেখা ৷

ছোটবেলা থেকে মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেন তিনি। বাবা ছিলেন একজন মুদি ব্যবসায়ী। ছয় ভাইবোন নিয়ে একটি বড় পরিবারে বাবার স্বল্প আয়ে সংসার চালানোটা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। তাই মা-কে একটি এনজিওতে কাজ করতে হয়েছে। আর্থিক অসুবিধা থাকার পরও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন রেখা।

একটা সময় টিউশনি করিয়ে নিজের পড়াশোনার কাজটি চালিয়ে গেছেন। সে সঙ্গে পরিবারকেও আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। ২০০৮ সালে ডিগ্রি পড়াকালীন বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারকে দেখার মতো কেউ ছিলেন না। মামা, খালা, চাচা কেউ এগিয়ে আসেননি। তখন তিন বোনের টিউশনের টাকায় সংসার চলে৷ সেই সময় রেখা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রায় ৬ বছর শিক্ষকতা করেন।

২০১২ সালে বাংলালিংকের ডিস্ট্রিবিউশন অফিসে কাজ শুরু করেন রেখা। চাকরি করেও সংসারে টানাপোড়েন থেকেই যাচ্ছিল বলে তিনি বাড়তি আয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ২০১৬ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন৷ তারপর চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ২০১৭ তে বিয়ে হয় তার, স্বামী ছিলেন গ্রীস প্রবাসী। বিয়ের পর স্বামীর টাকায় তার পরিবারকে দেখাশোনা করছিলেন।

যেহেতু স্বামীর সাপোর্ট রয়েছে তাই নিজের পরিবারের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ থেকেই ২০১৯ সালে অনলাইন প্লাটফর্ম চালু করেন ‘রঙতরু’ নামে। মেয়েদের পোশাক নিয়ে কাজ শুরু করেন। তখন টুকটাক লাইভ করতেন, প্রোডাক্টের ভিডিও দিতেন। শ্বশুড়বাড়ি থেকে বলা হলো, বউ কেন এটা করবে? আশপাশ থেকে অনেকে অনেক কথা বলতে শুরু করে। নিজের পরিবার বিশেষ করে মা-বোন তাকে সাপোর্ট করলেও স্বামীর কথায় মাস চারেক পর বন্ধ করে দিতে হয় সেই অনলাইন উদ্যোগ।

করোনাকালীন চার মাস শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন। তখন নিজের ফ্যামিলিকে কোনো সাপোর্ট দিতে পারেননি৷ ছোট বোনের টিউশনি আর ছোট ভাইয়ের উপার্জনের কিছু টাকা দিয়ে কোনোরকম চলতো তার পরিবার৷

পরিবারের এমন অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেন আবারও শুরু করবেন নতুন কিছু৷ ২০২০ এর মাঝামাঝি সময়ে ফেসবুকে একটি গ্রুপের সাথে পরিচিত হন এবং নিয়মিত সেটা ফলো করতে থাকেন। তারপর সবার অজান্তে ২০২১ সালে তিনি অনলাইনে আবারও কাজ শুরু করেন সরিষা তেল এবং ঘি নিয়ে। তার সাথে ছিল ক্লোদিং আইটেম, বুটিক্সের থ্রি পিস। তখন মাসে ৩০-৩৫ লিটার সরিষার তেল সেল হতো৷

দশ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেন উদ্যোগ। সেই টাকা দিয়ে প্রথমে ১৬ লিটার তেল ভাঙান। আর কিছু ঘি এবং ক্লোদিং আইটেম নিয়ে কাজ শুরু করেন৷ তারপর টাঙ্গাইলের হ্যান্ডলুম তাঁতের থ্রি পিস, শাড়ি, হাফ সিল্কের থ্রি পিস, সুতির থ্রি পিস যুক্ত করেন তার রঙতরুতে।

পরবর্তীতে সামাজিক পাতায় “আনন্দমেলা” নামক একটি গ্রুপের সাথে যুক্ত হন এবং উদ্যোক্তাদের নিয়ে মিট আপ গুলোতে অংশ নেন। পাশাপাশি অনলাইন এবং অফলাইনে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ নেন তার কাজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য।

২০২১ সালে আনন্দমেলা থেকে বাণিজ্য মেলায় অংশ নেয়ার জন্য তিনি অফার পান, সেখানে তার থামি ব্যাগ এবং দেশীয় থ্রি পিস, শাড়ি স্থান পায়। বেশ ভালো সাড়া পান বাণিজ্য মেলায়।

অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে তিনি তার বিজনেস পরিচালনা করে থাকেন৷ বর্তমানে তিনি ব্লকের শাড়ি, ব্যাগ, টাঙ্গাইলের থ্রি পিস-শাড়ি, পাওয়ারলুমের থ্রি পিস ও শাড়ি, কুমিল্লার তাঁতের পণ্য, থামির ব্যাগ, পাট পণ্য নিয়ে কাজ করছেন।

টাঙ্গাইলের হাফ সিল্ক দেশের বাইরে গ্রিসে গিয়েছে। দেশের ভেতর জামালপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ যাচ্ছে অনেক জেলায়। মাসে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। রাঙামাটি এবং টাঙ্গাইলে ৩ জন করে মোট ৬ জন কর্মী রয়েছে তার।

মা বোনদের সহযোগিতায় বাড়তি ইনকামের জন্য তিনি কাজ শুরু করলেও স্বামীর কাছ থেকে যে আর্থিক সহযোগিতা পেতেন তাও বন্ধ হয়ে যায়৷ যার কারণে তার উপর একটা চাপ পড়ে যায়। বিজনেসের টাকা দিয়েই বিজনেস দেখতে হচ্ছে, সেই সাথে মা বোনকে সাপোর্ট দিতে হচ্ছে, যে কারণে বিজনেসটা বড় পরিসরে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি জানান।

তবুও তিনি হাল ছেড়ে দেননি, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে এখনো হেঁটে চলেছেন। রওশন আরা রেখা বলেন, “আমি আমার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি এবং চালিয়ে যাবো। উদ্যোক্তা হিসেবে আমি যদি বলি বর্তমানে আমার পরিচিতি বেড়েছে। হয়তো সেল কম, তার কারণ আর্থিকভাবে পিছিয়ে আছি। কিন্তু শুরুতে আমার সেই পরিচিতিটা ছিল না। আমি উদ্যোক্তা হিসেবে আমার পরিচয়টাকে অনেক বড় পরিসরে নিতে চাই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমি আমার পণ্য ছড়িয়ে দিতে চাই এবং একটি অফলাইন শোরুম দিতে চাই৷”

নতুনদের উদ্দেশে তিনি বলেন: নতুন যারা কাজ করতে চায় তাদের বলবো তারা যেন ভেবে চিন্তে কাজ শুরু করে, অন্যদেরটা দেখে কাজ শুরু করা উচিৎ হবে না৷ মানুষ এখন ক্রিয়েটিভিটি খোঁজে, কাজেই নিজের উদ্যোগে সেই ক্রিয়েটিভিটি থাকতে হবে।

সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here