সফল নারী উদ্যোক্তা- গাজী লাইলী আক্তার স্বপ্না

ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় ১৩ বছর বয়স থেকেই একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন গাজী লাইলি আক্তার স্বপ্না। নাটক করেছেন, অভিনয় করছেন কিশোরী বয়স থেকে। অনেক গুলো টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন নানান চরিত্রে। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় স্বপ্নার। নিজে কিছু করার তাড়না তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কিছু করতেই হবে। ২০ বছর বয়সে ইন্টারমিডিয়েটে পড়া অবস্থায় আকবরি পোল্ট্রি থেকে ২০ কেজি চিকেনের প্রথম ড্রেসিং করেছেন হোম ডেলিভারী করার জন্য। ব্যবসা থেকে আসলো লাভ। ১০ হাজার টাকা পুঁজি। ২৫০০ টাকা লাভ এলো সেই ১০ হাজার টাকা থেকে। ভীষণ উৎসাহ বেড়ে গেলো। কম বয়সে বিয়ে হবার কারণে সংসারে নিজে স্বাবলম্বী হওয়া সেই সাথে স্বামীর পাশে শক্ত হাতে হাল ধরা তাকে যেন নতুন কিছু করবার জন্য মরিয়া করে তুললো।

পার্লারে কাস্টমারদের সার্ভিস দিচ্ছেন উদ্যোক্তার কর্মীগণ

ভর্তি হলেন বিউটিফিকেশন কোর্সে। ৬ মাসের কোর্সের ফি দিলেন নিজের ব্যবসার টাকা থেকেই। কোর্স শেষ তো স্বপ্ন শুরু। পোল্ট্রি ব্যবসা চলছে এবং তা থেকে লাভ আসছে ভালোই। ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা যখন মোট হলো পোল্ট্রি ব্যবসায়, তখনই প্রথম একটি বিউটি পার্লারের স্বপ্ন দেখলেন উদ্যোক্তা। ৭০ হাজার টাকা এডভান্স দিয়ে সিলেটে ৫০০ স্কয়ার ফিটে প্রথম দোতলা একটি বিউটি পার্লার দিলেন। ১ লক্ষ টাকার নানা বিউটিফিকেশন প্রোডাক্ট এবং সরঞ্জামাদি নিয়ে তিনি শুরু করলেন সুবিদ বাজারে এসকে ভবনে। নাম দিলেন অপরুপা।

কাস্টমারদের সেবা প্রদানে ব্যস্ত কর্মীগণ

৫ জন কর্মী ১৪ ঘণ্টা করে কাজ করা শুরু করলেন নিয়মিত। একজন দুজন করে কাস্টমার আসতে থাকে। ৬ মাস পরেই একসাথে ৬ টি বিয়ের কনে একদিনে সাজিয়ে ফেলেন উদ্যোক্তা। মনে অনেক আশা সঞ্চার হয়। সেদিনের সেই দিনটি বলে দিয়েছিলো তাকে পিছে ফিরে আর তাকাতে হবে না। সম্ভাবনা আছেই। সুনাম ছড়িয়ে পরে উদ্যোক্তার ভালো কাজে। গ্রাহক সংখ্যা এত বেড়ে গেলো যে, ৮ মাস পর ১০ জন নতুন কর্মীকে নিজেই ট্রেনিং দিয়ে নিয়োগ দিলেন নিজের পার্লারে।

বিয়ের কনে সাজাতে ব্যস্ত কর্মীরা

২০০৪ সালে দুইটি বছরের মধ্যে দ্বিতীয় শাখা খুলতে হলো অপরুপার। ২০০৪ সালে যেখানে ক্যাপাসিটি ছিলো ১৫ টি চেয়ার নতুন পার্লারে। নতুন ৮ জন কর্মীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলেন উদ্যোক্তা। হুহু করে বাড়তে থাকে কাস্টমার। উদ্যোক্তার সার্ভিসে, ব্যবহারে, সুনাম বেড়ে যায়। একটি স্বপ্ন যে উদ্যোক্তার স্বপ্নার জীবনে এতটা সফলতা আনবে নিজেকে নতুন করে চিনবে, চেনাবে তা উদ্যোক্তা ভাবেননি কখনো। আসলে সফলতার পথে হাটতে হলে যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, তাতে কিভাবে, কখন এসে সফলতা ধরা দেয় সেই সময়টুকুও উদ্যোক্তার থাকে না ভাববার। পথ শুধু এগিয়ে যাবার।

৫০০ জন লিস্টেড কাস্টমার। ২ টি বছরেই উদ্যোক্তার স্বপ্ন বাড়তে থাকে। উদ্যোক্তার অপরুপা তৃতীয় শাখায়। একজন সহ উদ্যোক্তার সাথে পুরোটা বুঝে নিতে হয় উদ্যোক্তাকে। সেখানেও ব্যবসা দেখলো সফলতার মুখ।

পূর্ব শিবগঞ্জ, ২৮ টি নতুন চেয়ার, নতুন বিউটি পার্লার জানিয়ে দিলো সফলতার সিঁড়ি ভাংতে শুরু করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা। ২৫ জন নতুন কর্মী নিয়োগ পেলেন এখানে। একের পর এক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নিজের উৎসাহকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলেন।

উদ্যোক্তার রেস্টুরেন্ট

২০০৯ সালে, উদ্যোক্তা ১৮ জন সহ উদ্যোক্তাকে নিয়ে সিলেটে খুললেন লাইফ স্টাইল রেস্টুরেন্ট। সিটি সেন্টারে স্পাইসি, জিন্দাবাজারে এক নতুন লাইফ স্টাইলে রেস্টুরেন্টের ভুবনকে চেনালেন উদ্যোক্তা। ১ হাজার জন বসে সেখানে লাইফ স্টাইল ডাইনিং করতে পারেন। এবং সেখানে সমস্ত পার্টি, সমস্ত কিছুর লাইফ স্টাইলে নতুন এক ছোঁয়া আসলো সিলেটে।

উদ্যোক্তা গাজী লাইলী আক্তার স্বপ্না এগিয়ে যেতে থাকেন। কাস্টমারের সংখ্যা ছাড়ায় বিউটি পার্লারে ১ হাজারের লিস্টে। হিমশিম খেতে হয় উদ্যোক্তাকে। বৌ সাজানো, পার্টি সাজ, মেহেদি, চুল বাঁধা, চুল কাটা, ফেসিয়াল, হেয়ার ট্রিটমেন্ট, নাক-কানা দাগা এসব সার্ভিসে নিজের নামকে আর নিজের ব্র্যান্ডকে ছড়িয়ে দিতে থাকলেন একটি জীবন সাজের ভুবনে। “অপরুপা” উদ্যোক্তার স্বপ্ন চার নম্বর পাখা মিললো। কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০’র ওপর ১২৪ টি সার্ভিস ক্যাটাগরিতে তিনি সাজাতে থাকলেন, দিতে থাকলেন কাস্টমারদের সেবা বিউটিফিকেশন এন্ড পার্লার ম্যানেজমেন্টে তার স্বপ্ন নিয়ে উদ্যোক্তার ভুবনে।

উদ্যোক্তার তৈরি মেন’জ পার্লার।

এরপর ৫ম শাখা সুনামগঞ্জ রোডে। ৫ম শাখায় ৪৫টি ক্যাটাগরির নতুন আর একটি পার্লার। উদ্যোক্তার জীবনে চলার পথে আর একটি পালককে নিয়ে সফলতার পথে এগিয়ে যাওয়া যেন। উদ্যোক্তা স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে হাটতে থাকেন।

অপরুপা মেন’জ। ষষ্ঠ শাখা। হেয়ার কাট, মেনি কিউর, পেডি কিউর, বডি স্পা, বর সাজানো, কালারিং, পিয়ার্সিং ফেস আউটলুক, হেয়ার আউটলুক ৮০ টি সার্ভিস ক্যাটাগরির পুরুষদের সৌন্দর্য চর্চার আরেকটি ভুবন যেন চিনিয়ে দেন উদ্যোক্তা তার স্বপ্নের ভুবনে।

উদ্যোক্তার তৈরি সিলেটের একমাত্র রিভারক্রুজ রেস্টুরেন্ট

২০১৫ সাল। সুরমা রিভারক্রুজ। সিলেটের প্রথম পানিতে ভাসমান যে রেস্তোরাঁ সেই রেস্তোরাঁর স্বপ্নটি উদ্যোক্তা দেখলেন আরও ২৫ জন সহ উদ্যোক্তাকে নিয়ে। ২৫০ জন একসাথে বসে এখানে উৎসবে খাওয়া দাওয়া করতে পারেন। সিজনে লাইফ শো, ডিনার সেই সাথে বিখ্যাত সুরমা নদীতে দুই ঘণ্টা রিভারক্রুজ এর প্যাকেজ। সিলেটের সুনামের ভুবনে আরও একটি সুনাম যোগ হয় উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে।

২০১৭ সাল, উদ্যোক্তার ‘অপরুপা’ লেডিস পার্লারটির ৭ম শাখাটি খুললেন শুভেচ্ছা মিয়া ফাজিশ্তি, সুবিধা বাজার সিলেটে। ক্ষুদ্রভাবে শুরু করে উদ্যোক্তা প্রশংসা পেয়েছেন অনেক, পেয়েছেন অনুপ্রেরণা এগিয়ে যাবার।

২৫০ জন কাস্টমার একসাথে ভাসমান এই রেস্তোরাঁয় বসতে পারেন

২০১১ সালে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড দিলেন উদ্যোক্তাকে। একজন সদস্য হলেন গ্রেটার সিলেট। জীবনে পথ শুরু করা একজন সংস্কৃতি কর্মী নাট্যলোক সিলেটে এখন একজন সদস্য কর্মীর মতোই ভালোবাসা দিয়ে কাজ করে চলেছেন।

২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে আজ গাজী লাইলী আক্তার স্বপ্না পরিচালনা করছেন প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যমানের ব্যবসা।

 

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here