বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষে বাংলাদেশের সফলতা

0

নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড কিংবা কাশ্মিরের মত শীত প্রধান অঞ্চলে টিউলিপ ফুল দেখা যায়। ভিউকার্ড কিংবা মুভির দৃশ্যায়নে আমরা প্রায়ই টিউলিপের বাগান দেখে থাকি। রংবেরঙের সেই টিউলিপ এখন বাংলার মাটিতে নান্দনিকতা ছড়াচ্ছে। গাজীপুরের শ্রীপুরে, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, যশোরের গদখালি এবং রাজশাহীতে বানিজ্যিকভাবে ফুল চাষে সাফল্য পেয়েছেন ফুল চাষীরা।

ভিনদেশি এই ফুল নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেন। তিনি একজন ফুলচাষী। মূলত শখের বশেই তিনি বিদেশি ফুল এবং সবজি নিয়ে কাজ করতেন। ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডের এক কোম্পানি টিউলিপের ১০০০ বাল্ব গিফট করে দেলোয়ারকে। তার ধারণা ছিল টিউলিপ বাংলাদেশে হবে না। বাল্ব লাগানোর ১০/১৫ দিন পর গাছ হয়। ২০২০ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে টিউলিপ ফুল ফোটে। চারিদিক থেকে এক অন্যরকম সাড়া পেতে শুরু করে দেলোয়ার হোসেন এবং বাংলাদেশের জন্য এক অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেন তিনি।

প্রায় ৩বছর ধরে উদ্যোক্তা দেলোয়ার হোসেন কাজ করছেন টিউলিপের বাগান নিয়ে। তৃতীয়বারের মতো এবার তিনি বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ বাগান করেছেন। তার বাগানে ১৩ ধরনের টিউলিপ রয়েছে তবে উদ্যোক্তা দেলোয়ার প্রতিনিয়ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন আরো বিভিন্ন ধরনের টিউলিপসহ বিদেশি ফুলও সবজি চাষের জন্য। উদ্যোক্তা দেলোয়ার হোসেন এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ ফুল চাষীকে টিউলিপ চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তিনি নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “টিউলিপ চাষ করতে হলে অবশ্যই জেনে এবং শিখে আসতে হবে তাছাড়া এই ফুল নিয়ে কাজ করা সম্ভব না”

চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে বীজ বপন করা হয় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার দরজিপাড়া এবং শারিয়ালজোত গ্রামে। স্থানীয় এনজিও ইএসডিও এর উদ্যোগে পিকেএসএফ এর সহযোগিতায় ক্ষুদ্র আটজন চাষীর প্রচেষ্টায় ২৫ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে পরীক্ষামূলক টিউলিপের সাফল্য মিলেছে। এই সাফল্যে কৃষি বিভাগ এবং স্থানীয় চাষীরা এখন বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষের সিদ্ধান্ত নেন। মূলত, কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশে শীতল আবহাওয়ার কারণে টিউলিপের সাফল্য পাচ্ছেন বলে মনে করেন স্থানীয়রা। সেখানকার ফুলচাষীরা মনে করছেন, ‘অন্যান্য চাষ থেকে এই টিউলিপ চাষটি অত্যন্ত উচ্চমানের তাই তারা খামার পর্যায়ে চাষে আগ্রহ পাচ্ছেন’।

পঞ্চগড়ের ইএসডিও এর নির্বাহী পরিচালক ড. মো.শহীদ উজ জামান বলেন, “মাঠ পর্যায়ে টিউলিপ চাষ সম্ভব হয়েছে আমরা বিশ্বাস করি আগামী দিনগুলোতে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষীদের মধ্যে অর্থনৈতিক আয় ও সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে ঠিক তেমনি পর্যটন শিল্পেও অনেক বড় অবদান রাখবে।”

দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ ঝিকরগাছা গদখালী থেকে এলেও এইবারই প্রথম সেখানে টিউলিপের চাষ করে সফল হয়েছেন উপজেলার পানিসারা গ্রামের ইসমাইল হোসেন; তার বাগানজুড়ে বাহারি রঙ ছড়াচ্ছে এই ফুল। চলতি বছর ৬ জানুয়ারি লাগানো বাল্ব থেকে চারা হওয়ার পর ২০ জানুয়ারিতে কুঁড়ি দেখতে পাওয়া যায়। পাঁচ শতক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচ হাজার বাল্ব লাগান ইসমাইল।

ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, “নেদারল্যান্ডস থেকে গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেনের মাধ্যমে সরকারি খরচে আট প্রজাতির পাঁচ হাজার বাল্ব আমদানি করা হয়।
ওই বাল্বই ইসমাইল হোসেনের বাগানে লাগানো হয়। এরই মধ্যে সানরাইজ, অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), লা বেলা রেড (লাল), মিল্কশেক রেড (লাল) প্রজাতির টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে।”

পর্যায়ক্রমে আট প্রজাতিরই ফুল ফুটবে বলে আশা প্রকাশ করে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ফুলের রাজ্য গদখালীকে মিনি নেদারল্যান্ডস হিসেবে পরিচিত করে তুলতে চাই।”

দেশের সর্বশেষ টিউলিপের সফলতা পায় রাজশাহী বিভাগ। রাজশাহী নগরী থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা-কাঁকনহাট সড়ক হয়ে কিছু দূর গেলেই দৃষ্টিনন্দন টিউলিপের দেখা মিলবে ‘ডিমার্স গার্ডেন’ এ। আম বাগানের ভেতরে দৃষ্টিনন্দন টিউলিপ বাগান করে তাক লাগিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা হাসান আল সাদী পলাশ। দৃষ্টিনন্দন এ বাগান দেখতেও প্রতিদিন ছুটে আসছেন দূর-দূরান্তের মানুষ।

পলাশ বলেন, “আমি ২০২০ সালের দিকে দেশে প্রথম টিউলিপের বাগান দেখি গাজীপুরের শ্রীপুরে। পরে চিন্তা করি রাজশাহীতেও টিউলিপ লাগানো যায়। কিন্তু প্রত্যাশিত জায়গা না পাওয়ায় বাগানের ভেতরেই টিউলিপের বাগান করি।”

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) উত্তম কুমার কবিরাজ বলেন, “রাজশাহীর বাঘা ও পবায় প্রায় ১৩ বিঘা জমিতে ফুলের চাষ হয়। এরমধ্যে এবছর পবায় টিউলিপ লাগানো হয়েছে। তারা বেশ সফলও হয়েছে।”

টিউলিপ ফুলের গাছ ১৭ সেন্টিমিটার থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। বাল্ব লাগানোর দুই সপ্তাহের মধ্যে কুঁড়ি আসতে শুরু করে। টিউলিপ শীতপ্রধান দেশের ফুল হওয়ায় এদেশে চাষের জায়গাটি প্রথমে সূর্যের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য শেড নির্মাণ করতে হয়। এরপর কাট-পেঁয়াজের মত টিউলিপ ফুলের বাল্ব মাটিতে সারিবদ্ধভাবে লাগাতে হয়। সূর্যের তাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মাটিকে রসালো রাখতে হয় সবসময়।

নেদারল্যান্ডস থেকে সংগ্রহ করা টিউলিপ ফুলের বাল্ব (কন্দ) প্রতিটির দাম পড়ে প্রায় ৭০ টাকা। আর এক একটি টিউলিপ ফুল বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়। ফুলটি ২০ দিন ধরে রাখা সম্ভব। বিদেশ থেকে বাল্ব নিয়ে আসতে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের শুল্ক লাগে। তাই এ ব্যাপারে কৃষি অধিদপ্তর হতে কৃষকদের সহযোগিতা প্রয়োজন- এমনটাই আশা করছেন টিউলিপ চাষীরা।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here