কোনো সভ্যতা একদিনে গড়ে ওঠে না। অনেক মানুষের প্রচেষ্টায় কালের পরিক্রমায় এক একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। প্রতিটি সভ্যতা গড়ে ওঠার নেপথ্যে একজন নায়কের ভূমিকা থাকে। আমাদের আজকের গল্প তেমনই একজন নেপথ্য নায়কের। যার নাম আব্দুর রহিম। যিনি তার মেধা, শ্রম, সাধনা ও অনন্য উদ্যোগের মাধ্যমে একটি জনপদের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী হিসেবে খ্যাত যশোরের গদখালী আজ যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে তাতে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি উদ্যোক্তা আব্দুর রহিম অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে ১৯৬৮ সালে একটি সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে আব্দুর রহিমের জন্ম। বাবা সুলতান আহমেদ ছিলেন একজন আদর্শ কৃষক। সেই সূত্রে জন্মগত ভাবে কৃষির সনাতন বীজ তার রক্তে বোনা ছিলো। তাই ১৯৮৯ সালে যশোর সিটি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেও কৃষিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি বাম রাজনীতি ও কৃষি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
১৯৯০ সালের দিকে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে ফুল চাষ শুরু করেন। প্রথমে দুই বিঘা পৈতৃক জমিতে করেন রজনীগন্ধা ফুলের চাষ। প্রথমবারেই স খরচ বাদ দিয়ে দুই লক্ষ টাকা লাভ হয়। ফুল চাষ লাভজনক হয়ে উঠায় চাষের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাইকারি ফুল ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কিং পিপলস এসোসিয়েশন (বাউপা) নামক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্পের এরিয়া ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। চাকরিতে অনীহা থাকলেও কৃষি সংক্রান্ত কাজ হওয়ায় এ দায়িত্বে তিনি আপত্তি করেননি। এ প্রকল্পের কাজ ছিলো মূলত ধান ও আলুর উন্নতমানের বীজ উৎপাদন ও কৃষকের মাঝে সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি ‘পদক্ষেপ’ নামের আর একটি কৃষি সংক্রান্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
ফুল চাষ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু ফুলের ন্যায্য মূল্য নিয়ে কৃষকদের বিপাকে পড়তে হয়। তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সংঘবদ্ধ হয়। আব্দুর রহিম প্রায় শুরুর দিক থেকেই এই ফুল চাষীদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। ১৯৯২ সালে তিনি গদখালী ফুল চাষী ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি একই সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পান। শুরুর দিকে বাংলাদেশে ফুলের কোনো নির্দিষ্ট পাইকারি বাজার ছিলো না। কৃষকরা বাসের ছাদে ফুল পাঠাতেন ঢাকায়। কিন্তু তারা সময়মতো টাকা পেতেন না। এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেন নিয়মিত টাকা পরিশোধ না করলে ঢাকায় আর ফুল পাঠাবেন না। দীর্ঘ এক মাস তারা ফুল পাঠানো বন্ধ রাখেন। বিক্রির অভাবে লাখ লাখ টাকার ফুল কেটে ফেলে দেন। আব্দুর রহিমের প্রচেষ্টায় ১৯৯৫ সালে গদখালী ও শাহবাগে ফুলের পাইকারি বাজার গড়ে উঠলে সমস্যার নিরসন ঘটে।
বাংলাদেশের মোট ২৫টি জেলায় ২০ হাজার উদ্যোক্তা ফুল চাষের সাথে যুক্ত। কিন্তু শুধু গদখালীতেই উৎপাদিত হয় দেশের মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশ ফুল। অন্যান্য জেলার ফুল চাষীদের সমস্যাগুলোর চিত্রও প্রায় একই রকম। সেজন্য সকলকে একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আব্দুর রহিম প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২০১২ সালে ইউএসএআইডি-এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ২০১৪ সালে এগ্রিকালচার ভ্যালু চেইন প্রজেক্টের আওতায় পানিসারা-গদখালীতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও আধুনিক ফুল বাজারের অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তার প্রচেষ্টায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন্দ্রীয় ফুল মার্কেট ও পাঁচটি এ্যাসেম্বল সেন্টার ও কেন্দ্রীয় ফুল গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে গদখালী ফুল চাষী ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি ২০১৮ সালে ন্যালসন ম্যান্ডেলা পদক লাভ করেন।
বর্তমানে ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা, নারাঙ্গালি, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, কুলিয়া, টাওরা, পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া গ্রামে দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। এর সাথে জড়িত আছেন প্রায় ৫ হাজার উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তা আব্দুর রহিম নিজেও এক একর জমিতে গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা সহ বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ করে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টাকা আয় করছেন। শুরুতে শুধুমাত্র রজনীগন্ধা ফুলের চাষ হলেও উদ্যোক্তা আব্দুর রহিমের প্রচেষ্টায় গদখালীতে ২০০৭-২০০৮ সালে ভারত থেকে জারবেরা এবং লিলিয়াম সহ বিভিন্ন দেশি বিদেশি জাতের ফুলের চাষ হচ্ছে। এ পর্যন্ত তিনি ২ বার দক্ষিণ কোরিয়া, ১ বার চীন, ১ বার নেদারল্যান্ডস, ১ বার থাইল্যান্ড ও ২ বার ভারত থেকে ফুল চাষের উপর প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, উন্নত জাত এনে বাংলাদেশের ফুল চাষকে আধুনিকায়ন করেছেন ও বাংলাদেশের ফুল চাষকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভের জন্য কাজ করছেন। তিনিই প্রথম চীনের গোলাপের ক্যাপ পদ্ধতি এদেশে চালু করেন। যার ফলে কৃষকরা এখন দ্বিগুণ লাভবান হচ্ছেন।
১৯৮৩ সালের দিকে সাতক্ষীরা জেলার বিশিষ্ট নার্সারি ব্যবসায়ী আব্দুল মাজেদ ও পানিসারার শের আলী নামের একজন কৃষক যশোরের নূর ইসলামের মাধ্যমে ভারত থেকে বীজ আনিয়ে ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে প্রথম ফুল চাষ শুরু করেন। আর সেই ফুল চাষকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বানিজ্যিক উৎকর্ষতার মাধ্যমে রীতিমতো একটি সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন উদ্যোক্তা আব্দুর রহিম ও তার চৌকস সহকর্মীবৃন্দ। ফুলকে কেন্দ্র করে গদখালী এখন রীতিমতো একটি বিনোদন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। এছাড়া এখানকার রাস্তা-ঘাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সহ বিভিন্ন ধরনের নান্দনিক অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। গত বিশ বছর আগেও সেখানে তেমন কিছুই ছিলো না। একজন ব্যক্তির একটিমাত্র মহৎ উদ্যোগ যে একটা পুরো জনপদের চেহারা পালটে দিতে পারে গদখালী এখন তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা