বছরে ২ কোটি টাকার হাঁসের পালক রপ্তানি করেন নওগাঁর সালাম

0

বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাঁসের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে রাজহাঁস, পাতিহাঁস ও চিনা হাঁস খুবই পরিচিত। এসব হাঁসের পালকের গুরুত্ব সম্পর্কে না জানার কারণে জবাইয়ের পর বেশিরভাগ মানুষই বর্জ্য ভেবে ফেলে দেয়। আর সেই পালক বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ করে বিদেশে রপ্তানি করেন নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার বালুভরা মহল্লার বাসিন্দা আব্দুস সালাম। প্রতিবছর ২ কোটি টাকার হাঁসের পালক রপ্তানি করেন তিনি।

বংশ পরম্পরায় আব্দুস সালাম হাঁসের পালক সংগ্রহের ব্যবসায় যুক্ত বহুদিন ধরেই। তার বাবা প্রয়াত মজিবর রহমান ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর নাহিদ ফেদার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মুরগি ব্যবসায়ী মজিবর রহমান হাঁসের পালক রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এই ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছিলেন উদ্যোক্তা মজিবর রহমান।

মুরগি ব্যবসার সুবাদে প্রায়ই ভারতের কলকাতায় যাতায়াত ছিল তার। সেখানকার ব্যবসায়ী বন্ধুদের মাধ্যমে বিদেশের বিভিন্ন পালক রপ্তানিকারকের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে মজিবর রহমানের। যা তাকে অল্প সময়ের মধ্যেই সাফল্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে সহায়তা করে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে হাঁসের পালক সংগ্রহে অন্তত ১০ হাজার কৃষক কাজ করতো মজিবর রহমানের হয়ে। যারা সারাদিন বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে পালক সংগ্রহ করতেন। এসব পালক মানভেদে বিভিন্ন দামে কিনে গোডাউনে মজুত করতেন মজিবর। এরপর তা থেকে নষ্ট এবং রপ্তানি অযোগ্য পালক বাছাই করে আলাদা করতেন তিনি। যা শুকিয়ে ভারত, আমেরিকা, চীন, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো।

মজিবর রহমানের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। যারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত। এদের মধ্যে মেজো ছেলে আব্দুস সালাম ১৯৮৫ সালে নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক পাশ করেন। তবে উচ্শিক্ষিত হয়েও কখনোই সরকারি চাকরির চেষ্টা করেননি আব্দুস সালাম। স্নাতক শেষে বৃদ্ধ বাবার ব্যবসায়িক কাজে সার্বিক সহযোগিতা করতেন তিনি।

ছেলে ব্যবসার হাল ধরার পর মজিবর রহমানের ব্যবসা আরও প্রসারিত হতে থাকে। প্রতি মাসে অন্তত ১০-১৫ টন পালক রপ্তানি করতেন আব্দুস সালাম।

এরই মধ্যে ১৯৯৫ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান মজিবর রহমান। ওই বছরে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে পুরো বাংলাদেশ। এদিকে দুর্যোগকালীন সময়ে আমেরিকা থেকে ১০ টন হাঁসের পালক রপ্তানির অর্ডার পান আব্দুস সালাম। রপ্তানির জন্য বাছাইকৃত পালকগুলো গোডাউনে বন্যার পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। যা পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের আর্থিক লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায় আব্দুস সালামের। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাড়তে থাকে দূরত্বও। তখন থেকেই ব্যবসা কিছুটা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন আব্দুস সালাম।

সময়ের ব্যবধানে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশীয় বাজারে আসতে থাকে অত্যাধুনিক পালক বাছাইয়ের মেশিন। তবে আর্থিক সংকটে তা কিনতে পারেননি তিনি। তখন থেকেই পালক রপ্তানিতে তার সহায়তা নিতে হয় ঢাকার এলিয়েন্স ফেদার প্রোডাক্টস লিমিটেডের কাছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাইকারি মূল্যে পালক বিক্রি শুরু করেন আব্দুস সালাম।

বর্তমানে ঢাকার আরেক পালক রপ্তানিকারকের মাধ্যমে ভারত, চীন, জার্মানি ও তাইওয়ানে হাঁসের পালক পাঠাচ্ছেন তিনি। মানভেদে এসব পালক সংগ্রহ করা হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে।

উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে এসব পালক সংগ্রহ করছেন হাজারো হকার ও সাব এজেন্ট। মূলত গ্রামের মৌসুমি বেকার শ্রমিক ও কৃষকরাই পালক সংগ্রহে বেশি আগ্রহী। তবে দিন দিন কমছে পালক সংগ্রহের পরিমাণ। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে হাঁস জবাই আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১০০ টন হাঁসের পালক সংগ্রহ করছেন আব্দুস সালাম। এসব গোডাউনে আনার পর মজুত করে বাছাইয়ের পর বছরে অন্তত ৭০ টন হাঁসের পালক ২ কোটি টাকায় রপ্তানিকারক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন তিনি।

আব্দুস সালামের কারখানায় ১৯৮২ সাল থেকে পালক বাছাইয়ের কাজে নিয়োজিত আছেন আকবর হোসেন ও সুজা সরদার। তারা বলেন, কয়েক যুগ ধরে পালক সংগ্রহে মাঠ পর্যায়ে কাজ করি। পাশাপাশি কারখানায় আনার পর ওইসব পালক থেকে রপ্তানি অযোগ্য পালক বাছাই করেই সংসারের খরচ চলে। এসব পালক বস্তায় প্যাকেটিং করে ঢাকায় নেওয়া পর্যন্ত দৈনিক কারখানায় কাজ করে ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক পায়।

১৯৯৪ সাল থেকে ওই কারখানায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, আগে দৈনিক কমপক্ষে ৬০০ কেজি পালক সংগ্রহ করা হতো। এখন হাঁস জবাই আগের মতো আর নেই। দৈনিক ৩০০ কেজি পালক কেনাটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। যখন মালিক সরাসরি রপ্তানি করতেন তখন কারখানায় দিনরাত সার্বক্ষণিক ২৫ থেকে ২৬ জন শ্রমিককে কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হতো। এখন সেখানে মাত্র ৪-৫ জন কারখানা শ্রমিক পালক বাছাই করছে। বর্তমানে প্রতি বছর অন্তত ২ কোটি টাকার পালক দেশীয় রপ্তানিকারকের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে।

নাহিদ ফেদার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী উদ্যোক্তা আব্দুস সালাম বলেন, বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে পুঁজি সংকটের কারণে সরাসরি বিদেশে রপ্তানিতে আবারও ফেরার মতো সাহস পাচ্ছি না। যেই পালক সংগ্রহ করা হয় তা শ্রমিকদের দিয়ে বাছাই করতে গেলে প্রায় ৩০ শতাংশই রপ্তানি অযোগ্য হয়ে পড়ে। এ জন্য প্রয়োজন আধুনিক বাছাই মেশিন। যার দাম কয়েক কোটি টাকা।

তিনি আরও বলেন, হাঁসের পালক থেকে বিদেশে বহুল চাহিদা সম্পন্ন মূল্যবান লেপ, তোশক, কম্বল ও বিছানার চাদরসহ নানাবিধ শীতের কাপড় তৈরি করা যায়। প্রসেসিং মেশিন কেনায় সরকারি সহযোগিতা পেলে এসব পালক দিয়ে নিজে থেইে পণ্যগুলো তৈরি করতাম এবং তা সরাসরি রপ্তানির সুযোগ পেলে আরও কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতো।

ঢাকার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এলিয়েন্স ফেদার প্রোডাক্টস লিমিটেডের পরিচালক মোবাশ্বের হায়দার বলেন, আমরা অপ্রচলিত হাঁসের পালক থেকে লেপ, তোশক, কম্বল ও বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন বস্ত্র তৈরি করি। যা দেশীয় বাজারে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে বিক্রি করা হয়। এর পাশাপাশি হাঁসের পালক বাছাই করে প্রতি বছর তাইওয়ানে ৮ কনটেইনার করে রপ্তানি করতাম। যেখানে প্রতি কনটেইনার থেকে ২০ হাজার ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসতো।

কোভিডের আগ পর্যন্ত ব্যবসাটিকে সম্প্রসারিত বিভিন্ন দপ্তরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ছুটে বেড়িয়েছি। তবে কোনো সাড়া মেলেনি। তাই বাধ্য হয়ে এখন পালক রপ্তানি বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নওগাঁর উপ ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন জানান, হাঁসের পালক রপ্তানি একটি সম্ভাবনাময় ব্যবসা। তবে পালক থেকে বিভিন্ন বস্ত্র উৎপাদন করলে তা আরও লাভজনক। সেই দিক বিবেচনায় আব্দুস সালামকে বিসিক থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে। তাকে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানসহ উৎপাদিত পণ্য বিপণনে বিসিক সবসময় পাশে থাকবে।

ডেস্ক রিপোর্ট,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here