বগুড়ার গাবতলী উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে পুকুর বা ডোবার কচুরিপানা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্যাগ এবং মাদুর। মজবুত এবং টেকসই ব্যাগটি দশম জাতীয় এসএমই পণ্যমেলায় আলোড়ন ফেলেছে। কারণ অব্যবহৃত কচুরিপানাকে সৃষ্টিশীলভাবে কাজে লাগিয়েছেন বগুড়ার সন্তান মোঃ মোস্তাফিজার।
২০২০ সালে একটি সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কৃষিনির্ভর এবং কৃষি-প্রযুক্তির উন্নয়নভিত্তিক আলোচনায় কচুরিপানার কথাটি উল্লৈখ করেন। তিনি বলেন, ‘গরু কচুরিপানা খেতে পারলে আমরা কেন ব্যবহার করতে পারবো না!’ কচুরিপানাকে কাজে লাগানোর বিষয়ে তিনি বিশিষ্টজনদের অনুরোধ করেন।
বিষয়টি বেশ ভালো লাগে মোস্তাফিজারের। তিনি তার আশে পাশে থাকা কচুরিপানা সংগ্রহ করে গবেষণা শুরু করেন। প্রায় ৬/৭ মাস তিনি বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। গবেষণা এবং পরিশ্রমের ফসল হিসেবে তিনি কচুরিপানা দিয়ে ব্যাগ তৈরি করতে সক্ষম হোন। ব্যাগ তৈরি করে তিনি থেমে থাকেননি, দেখা করেন মন্ত্রীর সাথে। মোস্তাফিজারের এই চেষ্টাকে মন্ত্রী বেশ প্রশংসা করেন এবং এর মার্কেট তৈরিতে কাজ করার আহ্বান জানান।
মোস্তাফিজার এবং তার স্ত্রী শিরিন বেগম সেই কাজটি করছেন নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে। কচুরিপানার ব্যাগের চাহিদা স্থানীয় পর্যায়ে তেমন না থাকায় মোস্তাফিজার বুঝতে পারেন বড় বড় মেলাগুলোতে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই ব্যাগের মার্কেটপ্লেস তৈরি করা সম্ভব হবে। সেই চেষ্টা থেকেই এবারের দশম জাতীয় এসএমই মেলায় প্রথমবারের মতো অংশ নেন মোস্তাফিজার এবং শিরিন বেগম।
কীভাবে কচুরিপানা থেকে ব্যাগ তৈরি হয়? প্রথমে পুকুর ও ডোবা থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে গরম পানিতে আধা সিদ্ধ করা হয়। তারপর সেটাকে আবার শুকিয়ে নেওয়া হয় রোদে। দীর্ঘদিন রং ঠিক রাখার জন্য টেক্সটাইলের স্বাস্থ্যসম্মত কেমিক্যাল দেওয়া হয় এবং রোদে শুকানো হয়। এরপর তাঁত মেশিনে কাটিং করে বিভিন্ন ডিজাইন। এভাবে কচুরিপানা দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের লেডিস ব্যাগ, মাদুর তৈরি করছেন মোস্তাফিজার ও শিরিন দম্পতি।
এভাবে মোস্তাফিজারের উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে কষ্টের একটা অভিজ্ঞতা আছে।
২০০৪ সালের দিকে মোস্তাফিজার টেইলারিং এর কাজ করতেন। পাশাপাশি ছিলেন কাঁচামালের আড়তদার। ব্যবসায় বড় ধরনের লস হওয়ায় টেইলারিং মেশিন বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হয়। পুরোপুরি বেকার হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
সেই সময় স্ত্রীকে সাথে নিয়ে রংপুরে ফুপাতো বোনের বাসায় বেড়াতে গেলে সেখানে গিয়ে মোস্তাফিজার দেখতে পান কিছু নারী শতরঞ্জির কাজ করছেন। তাদের কাজ দেখে তিনি এবং তার স্ত্রী শিরিন বেগম খুব উৎসাহিত হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন শতরঞ্জির কাজটি তারাও শিখবেন।
দীর্ঘ ৬/৭ মাস বোনের বাসায় থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিনা পারিশ্রমিকে শতরঞ্জির কাজ শিখলেন। মোস্তাফিজার যেহেতু টেইলারিং কাজটি জানতেন তাই তিনি সেখানে একটি দোকানে পার্ট টাইম টেইলারিং কাজও শুরু করেন।
কাজ শেখার পর ২০০৮ সালে রংপুর শতরঞ্জি পল্লী লিমিটেডে মোস্তাফিজার এবং তার স্ত্রী শিরিন বেগম হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কাজের দক্ষতা এবং পারদর্শিতায় অল্প দিনেই পদোন্নতি হয় তাদের৷ পাঁচ বছরের মধ্যে হেলপার থেকে ম্যানেজার পদে পদোন্নতি হয় মোস্তাফিজারের। শিরিন বেগম ৫০ জন নারী কর্মীর সুপারভাইজার নিযুক্ত হোন। হঠাৎ করেই ২০১৪ সালে বেতন ভাতায় অনিয়ম দেখা দেয় এবং কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যায়। মোস্তাফিজার সিদ্ধান্ত নেন কাজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার নিজেই কিছু একটা করবেন।
তারপর ফিরে গেলেন নিজ এলাকায় বগুড়ায়। সেখানে গিয়ে নিজের জমানো ১০/১২ হাজার টাকার সাথে ধার দেনা করে প্রায় ২০ হাজার টাকা এবং শাশুড়ির দেওয়া কাঁঠাল গাছ দিয়ে তিনটা মেশিন তৈরি করে ছোট্ট একটি কারখানা দিলেন৷ উদ্যোগের নাম দিলেন মনিব ফ্যাশন হাউজ অ্যান্ড হান্ডিক্র্যাফট। তিনি শতরঞ্জি, টেবিল ম্যাট এবং ডাইনিং সেট তৈরি শুরু করেন। কিন্তু পর্যাপ্ত মূলধন এবং চাহিদা না থাকায় দুই বছরের মাথায় তা বন্ধ করে দিতে হয়।
পরে তিনি জুট কটন ফেব্রিক্স নিয়ে কাজ শুরু করেন। এতে ৬০% জুট এবং ৪০% কটন মিক্সড থাকে৷ এই ফেব্রিক্স দিয়ে তিনি লেডিস ব্যাগ, শপিং ব্যাগ এবং লাঞ্চ ব্যাগ তৈরি করছেন। বর্তমানে স্থানীয় বাজার বগুড়া ছাড়াও ঢাকা, ময়মনসিংহ, রংপুরে সরবরাহ করছেন ওইসব ব্যাগ।
মাসে ৮০০ থেকে ৯০০ গজ ফেব্রিক্স তৈরি করেন তারা এবং হাজার/বারশর মতো ব্যাগ উৎপাদন করেন। আনুমানিক মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা সেল হয়।
২০২১ সাল থেকে তিনি কচুরিপানার ব্যাগ তৈরির কাজটি নিয়মিত শুরু করেন। বর্তমানে তিনি জুটকটন ফেব্রিক্স এবং কুচুরিপানা নিয়ে কাজ করছেন। তবে শতরঞ্জির অর্ডার এলে সেটাও করেন তিনি। তার কারখানায় ছয়জন কর্মী কাজ করেন।
উদ্যোক্তা মোস্তাফিজার বলেন, ‘কর্মহীন মানুষকে কর্ম দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানো এবং দেশ ও দেশের বাইরে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রসার ঘটানোই আমার মূল লক্ষ্য’।
সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা