খেলা একটা বাচ্চার প্রধান কাজ। খেলার মাধ্যমেই হয় একটা শিশুর সার্বিক বিকাশ। ঢাকা শহরে খেলার জায়গার যেমন সুযোগ কম তেমনি নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি কনসেপ্ট, কর্মজীবি মায়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়াতে বাচ্চারা বিশেষ করে ০-৫ বছর বয়সি বাচ্চারা অনেক বেশি একা হয়ে পড়েছে। অথচ এই বয়সি বাচ্চাদের সবচেয়ে বেশি এটেনশন দরকার কারন এটা তার ফাউন্ডেশন টাইম। বাচ্চাদের এই আর্লি চাইল্ডহুড ডেভলপমেন্ট স্টেজ- এ একটা ডে কেয়ার সেন্টার তার স্ট্যান্ডার্ড কারিকুলাম দিয়ে বাচ্চাদের এই ফাউন্ডেশন টাইম কে সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারে। ডে-কেয়ার মানে শুধু নিরাপদ খাওয়া এবং ঘুমের জায়গা না। ডে-কেয়ারে একটা বাচ্চা দিনের ৭/৮ ঘন্টা থাকে তাই সেখানে শিশুর আদব-কায়দা সহ সবকিছু শেখানো হয়।
আপনার ছোট্ট সোনামনি কে শুধু কিছু বইপত্র খাতা-কলম কিনে দিয়েই নিজেকে দায়িত্বশীল অভিভাবক ভাবছেন? যদি এমনটাই হয় তাহলে আপনাকে একটু ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ভাবনায় পরিবর্তন আনতে হবে।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ আর এই মেরুদণ্ড যদি হয় ভাঙ্গা তাহলে সে জাতি কখনও-ই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে কিভাবে মেরুদণ্ড তথা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে না যায়। কোমল মতি শিশুরা ছোট বেলা থেকেই সুন্দর একটা আনন্দদায়ক পাঠদানের মাঝে বেড়ে উঠতে পারে। সেদিকটা সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন ‘এবিসি আর্লি লার্নিং এন্ড ডে কেয়ার সেন্টার’ এর প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া ফারজানা আকরাম।
শুরুটা ২০০৯ সালে, অস্ট্রেলিয়ার প্রিস্কুলে- ডে কেয়ার এ একটি কাজের সুযোগ পান সোনিয়া ফারজানা। সেখানে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। ছোট ছোট শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন ৩-৫ বছরের বাচ্চারা সব কিছুতে খুব পটু। এতো ছোট বয়সে এতো কিছু কিভাবে জানে। কি সৌভাগ্যপূর্ণ এদের শৈশব, এরা রঙ তুলি নিয়ে খেলে ইচ্ছেমত আঁকিবুকি করতে জানে। কাঁচি দিয়ে ভয়ভীতি ছাড়াই নানান প্যাটার্নে কাগজ কাটছে।কাঠি হাউজে ঢুকে নানান বয়সি বাচ্চারা গল্প করছে। আবার বালির ভিতর (স্যান্ড পিট) এ বসে নানা শেপ আর মেজারমেন্ট এক্সপেরিয়েন্স করছে। এদের সাথে একটু কথা বললেই বোঝা যায় জীবনের অনেক বিষয় সম্পর্কে ওদের ধারনা একদম যুক্তিযুক্ত এবং সোজাসাপ্টা। তখনি এই আর্লি লার্নিং এডুকেশন এর সবকিছু জানার আগ্রহ হয় সোনিয়া ফারজানা আকরামের আর সেখান থেকেই এবিসি আর্লি লার্লিং এন্ড কেয়ার সেন্টারের ভাবনা আসে।
২০১৩ সালে ছুটিতে দেশে আসেন এবং কিছু মার্কেট সার্ভের কাজ করেন। তারপর ২০১৭ সালে তার সামাজিক উদ্যোগ এবিসি আর্লি লার্নিং সেন্টার এর প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন। এ সম্পর্কে সোনিয়া ফারজানা বলেন, ‘ প্রথমেই আমি বলতে চাই এই উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াতে যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তারা হলেন মিডল ইস্টার্ণ ডিরেক্টর যার নাম মারভেট জর্বা, একজন বাঙ্গালী সদস্য ফাতেমা এবং একজন টার্কিশ কলিগ কাদরিয়ে পালা যাদের অবদান অস্বীকার্য আর দেশে এই উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে সবচেয়ে বড় অবদান আমার হাসবেন্ডের, যে আমাকে সবসময় বিশ্বাস করে আর প্রতিটি স্টেপ এ সহযোগিতা করেছে। আর একজনের কথা যেটা না বললেই না সে হলো আমার শ্বশুর, যিনি কোন রকম শর্ত ছাড়াই আমাকে ফিন্যান্স করেছে পুরো বিজনেস সেটআপ এ’।
তিনি আরও বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! শুরুর এক বছরের মাথায় আমার সেন্টারটি ফুল হয়ে যায় এবং আমি সেকেন্ড সেন্টার এক্সপেনশন এ যাই। আমার লিটল মাস্টাররা এখানে ফেয়ারলেস ভাবে আঁকিবুঁকি, কাঁচি দিয়ে কাগজ কাটতে পারে। রং-তুলি দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। একটা ক্যাটার পিলার থেকে কিভাবে বাটারফ্লাই হয় সেটাও তারা জানে। জানে কিভাবে আর একটা বন্ধুর সাথে টার্ন টেক করে খেলতে হবে। ওদের সাথে আমরা কমিউনিটি হেল্পারদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। ওরা পুলিশ, ফায়ারফাইটার, ডেন্টিস্ট, ডক্টরের মত প্রফেশনগুলো খুব ভালো জানে। এটার পাশাপাশি অ্যালফাবেট, নাম্বার শেপ এর ধারনা, প্রি-সাইন্সের ধারনা গুলোও পায়’।
০-৫ এই বয়সটা একটা বাচ্চার জীবনের ফাউন্ডেশন টাইম। এই বয়সের গুরুত্ব অনেক বেশী কারণ। এই সময় তার মস্তিস্কের ৮৫% উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন হয়। যখন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক আবেগীয় আর ভাষাগত দক্ষতার সমন্বয় ঘটিয়ে বেড়ে ওঠে প্রতিটি শিশু। এই সময়ে শিশুর মস্তিস্কের প্রতিটি কোষ একে অন্যের সাথে একটিভ হয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে তার হলিস্টিক ডেভেলপমেন্ট এনসিউর করে। তাই এই বয়সের সঠিক পরিচর্যা খুবই জরুরী। ডেকেয়ার এ সাধারণত ০-৫ বছর বয়সী বাচ্চারা থাকে তাই ডেকেয়ার সেটিং এ হাই কোয়ালিটি আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন নিশ্চিত করা খুবই জরুরী। আর হাই কোয়ালিটি আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশনের বৈশিষ্ট্য হলো একটি ন্যাশনাল স্টান্ডার্ড এর আওতায় একটি কারিকুলাম গোল থাকবে যেই কারিকুলাম নিশ্চিত করবে শিশুর ৫টি ডেভলপমেন্টাল ডোমেইন (ফিজিক্যাল, কগনেটিভ, সোসিয়াল, ইমোশনাল এন্ড ল্যাংগুয়েজ)।
সামাজিক উদ্যোক্তা সোনিয়া ফারজানার প্রতিষ্ঠিত এবিসি আর্লি লার্নিং ডেকেয়ার সেন্টারে টিচার্স এন্ড কেয়ার গিভার টিম অস্ট্রেলিয়ান স্টান্ডার্ড ইন্সপায়ার কারিকুলাম সেটিং এ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে প্রতিটি বাচ্চার জন্য ইউনিক কারিকুলাম সেট করা হয় এবং বিভিন্ন প্লে একটিভিটিস এর মাধ্যমে ডেভলপমেন্টাল মাইলস্টোন গোল অর্জন করার কাজ হয়। ভবিষ্যৎ ভাবনা- আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন সুবিধা বাড়াতে প্রথমেই দরকার এই বিষয়ে পড়াশোনা । তাই খুব শীঘ্রই এবিসি আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন ট্রেনিং ইন্সটিটিউট খোলার ইচ্ছা আছে উদ্যোক্তার। যেখানে ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড প্লাটফর্ম এর আওয়তায় প্রশিক্ষণ নিতে পারবে।
সামাজিক এই উদ্যোগ গুলোকে সফল করার জন্য সম্প্রতি ওয়াই গ্যাপ (Y-gap) এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সারাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা হাজার হাজার প্রতিযোগিদের মধ্যে সামাজিক উদ্যোক্তা সোনিয়া ফারজানা আকরাম প্রথম ১২তে স্থান করে নিয়েছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের কর্পোরেট জোনগুলোতে আমার সেবা বিস্তার করার মাধ্যমে নারীদের চাকুরী ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা কমাতে চাই। বৃহৎ ভাবনার রয়েছে প্রতিটি জেলাতে আমার সেবা বিস্তার যাতে আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন এর মাধ্যমে ম্যাক্সিমাম বাচ্চার ফাউন্ডেশন টাইমটাকে নিশ্চিত করা যায়। কারণ এই ফাউন্ডেশন টা সঠিকভাবে নার্সারি করতে পারলে এই বাচ্চাগুলো স্কুলগুলোতে একাডেমিক্যালি এবং সোশ্যালি অনেক ভালো করবে’।
বিপ্লব আহসান
স্পেশাল করেস্পন্ডেন্ট ,উদ্যোক্তা বার্তা