মগবাজারে জন্ম ফারহানা মুনমুনের, সেখানেই বেড়ে উঠা। ছেলেবেলা পেরিয়ে বড়বেলায় এসে জীবনের প্রয়োজনে কিছু একটা করার তাগিদ এলো। দেশের বাইরে যেয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছে ছিল। সেই প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন। হঠাত করেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। এলাকার এক ছোট্ট বিউটি পার্লার থেকে কাজ শেখা হলো ১৯৯৮ সালে। মগবাজার থেকে আজিমপুর ট্রেনিং নিতে আসতেন যখন দূরত্বটা বেশ ভোগাতো। দুপুরের খাবার হিসেবে বক্সে ভরে আনা ভাত গরমে গন্ধ হয়ে যেত। খাওয়া যেত না। তাই বুদ্ধি করে রুটি নিয়ে আসতেন ট্রেনিং এর সময়। আহ্লাদে বড় হওয়া মেয়েটি রোজ রোজ রুটি খেয়ে মন খারাপ করতেন। বহুদিন চোখের পানি রুটিতে পরেছে। সেই রুটিই খেয়েছেন। ২১বছর আগের সেই আবেগী রুটির গল্প আজ সোনালী অতীত।
পার্লারে কাজ শেখার সময় লোকে নানান কথা বলল, তাচ্ছিল্য করত। মানুষের তাচ্ছিল্য ছিল অনুপ্রেরনা আর জেদ। একসময় কাজ শেখা হলো। সেসময় ইউটিউব এতোটা সহজ ছিল না যে ঘরে বসেই কাজ শেখা যাবে। একেকটা কাজ হাতেকলমে শিখতে অনেকটা সময় দিতে হয়েছে, শ্রম দিতে হয়েছে। একসময় নিজের পার্লার দেবার চিন্তা করে বাসা ভাড়া করতে গলির পর গলি হেঁটেছেন। বাজেট আর পছন্দের পার্লার উপযোগী ঘর না পাওয়ায় দমে যাননি একবারও। অনেক বাড়িওয়ালা বলেছেন, “তোমার পার্লার তো এখানে চলবে না।” নিজে সাহস নিয়ে তখন উত্তর দিয়েছন, “আপনি বাসা ভাড়া দিন, পার্লার আমিই চালাবো।” সেই সাহস আর আত্মবিশ্বাস বৃথা যায়নি। একসময় নিজের ৩টি পার্লার একা সামলে নিয়েছেন সেই আত্মবিশ্বাসের জোরেই। সন্তানের জন্মের জন্য ৩টি পার্লার থেকে ২টি নিয়ে কাজ করেন। কর্মজীবী মা হলে সন্তানের জন্য একটু তো ছাড় দিতেই হয়।
নিজের ক্যারিয়ারে সাফল্যে বড় বোনের অবদান অনস্বীকার্য। পার্লার নিয়ে কাজ করলেন কেন? উত্তরে ফারহানা মুনমুন জানান, “পরিপাটি হয়ে চলতে সকলেই ভালোবাসে, সময়ের অভাবে যারা নিজের পরিচর্যা নিতে পারেন না তাদের জন্যই আমার এই প্রতিদিনের আয়োজন। ২১বছরে কিছুই করিনি, শুধু সেবা দিয়েছি। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন কর্মশালা ও ট্রেনিং এ। ব্র্যাকের এক ওয়ার্কশপে কানিজ আলমাসের কাছে ট্রেনিংও নিয়েছেন আজ থেকে ১০বছর আগে।
কাস্টমারদের জন্য ফারহানার বিউটি পার্লার প্রায় সারাবছর ডিসকাউন্ট সিস্টেম রাখেন। এটি মার্কেটিং পলিসি নাকি অন্য কিছু এই সম্বন্ধে জানতে চাইলে ফারহানা বলেন, “আমি চাই মানুষ পরিপাটি হয়ে থাকুক। যাদের অর্থ আছে তারা তো বটেই, সেই সাথে যাদের একটু সামর্থ্য কম বা যারা এখনো স্টুডেন্ড তারা কেন নয়? তাদের জন্যই আমার সেবা।”
মেয়েদের নিজের স্বনির্ভরতা কেন প্রয়োজন এই প্রশ্নে তিনি জানান, “স্বামী বা পরিবার ভাত-কাপড় দেবেই, পরিচয়টা নিজেকেই গড়তে হয়।” বলা যায় পরিচয় আর নিজের স্বচ্ছলতার জন্যই নিজের অয়ায়ে দাঁড়ানো উচিত সকল নারীর। নিজের পার্লারে অনেক আদিবাসী মেয়েদের কর্মসংস্থান গড়েছেন ফারহানা। যারা কাজ করছেন তারা সকলেই গারো সম্প্রদায়ের। যারা কাজ করছেন তাদের মাঝে গারোদের আধিপত্যের কারন জিজ্ঞাসা করলে ফারহানা বলেন, “গারো উপজাতিরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। তাদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রচেষ্টা দৃঢ় থাকে। তাদের সেই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানাই। লুসি, ইমা, মং ওরা আমার পরিবারের মতো আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে।”
সাদিয়া সূচনা