নুসরাত জাহানের বাবা ছিলেন একজন মাওলানা। তিনি ছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। মা গৃহিনী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সেজো। ১৯৯১ সালের ২২ আগস্ট কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে তার জন্ম। জন্ম ও বেড়ে উঠা সবই শহরে। গ্রামের বাড়ি চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চান্দিশকরা গ্রামে। লেখাপড়া কুমিল্লা শহরের ইবনে তাইমিয়া স্কুলে শুরু হয়, এরপর ফরিদা বিদ্যায়তনে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন, ৯ম শ্রেনীর মাঝামাঝিতে তার বাবা সৌদি আরব থেকে ফিরে এসে তাকে গ্রামে নিয়ে যান। ২০০৬ সালে চৌদ্দগ্রাম গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি ও ২০০৮ সালে চৌদ্দগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে এইসএসসি পাশ করেন। এরপর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইতিহাস বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স।
লেখাপড়া শেষে কুমিল্লা বেতার ও অনলাইন সংবাদপত্রে চাকরি করেন এবং এলাকার স্কুলে শিক্ষকতাও করেন অনেকদিন। ২০১৪ সালে বাবা মারা যাওয়ায় অনেক ভেঙে পড়েছিলেন। আর বাবা মারা যাওয়ার ৪ মাস পর তার প্রথম সন্তান দুনিয়ায় আসে। সন্তান পেয়ে সব মিলিয়ে ভালো কাটলেও কোথাও যেনো একটা শূন্যতা থেকেই যায়। খুব একাকীত্ব বোধ হতো, মাথায় আসে একাকীত্ব ঘুঁচবে এমন কিছু করবেন। তখন কুমিল্লায় কেউই ছিলেন না খাবার নিয়ে কাজ করার। পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় রান্নাটা খুব ভালো পারতেন। সেদিক চিন্তা করেই কুমিল্লায় তিনি প্রথম ২০১৭ সালে অনলাইনে হোম মেড ফুড নিয়ে কাজ শুরু করেন।
তার মাথায় আসে যে অনেকেই আমরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাচ্ছি না বা পাচ্ছি না। সবার কাছে ফ্রেশ খাবার পৌঁছে দেয়ার চিন্তাও মাথায় আসে। প্রথমে কাছের কিছু মানুষের কাছে খাবার সেল করেন অগ্রিম টাকা নিয়ে। আস্তে আস্তে যখন নিজের ভেতর কাজ করার আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা বাড়ে, তখন তিনি কুমিল্লার ফুডিস গসিপ নামের ফুড গ্রুপের এডমিন জয়-এর সাহায্যে পেজ খোলেন। তার প্রথম বড় অর্ডার ছিল ৭০ জনের মোরগ পোলাও। ঢাকা মাইলস্টোন কলেজ থেকে কুমিল্লা কোটবাড়িতে পিকনিকে আসে একটা ইউনিট। তারা স্বস্থ্যসম্মত খাবারের খোঁজ করতেই তিনি সাহস করে পারবো বলে দেন। তারা তাকে ১০ হাজার টাকা অগ্রিম দেন, যা দিয়ে তিনি কাঁচামাল ক্রয় করেন।
বর্তমানে তিনি সব ধরনের হোম মেড ফুড নিয়ে কাজ করছেন। যেমন: রাইস আইটেম, ফ্রোজেন, মিষ্টি, কেক, স্ন্যাকস এবং এর পাশাপাশি কুকিং ও বেকিং এর একজন প্রশিক্ষকও তিনি। পণ্যের মানের সাথে কোনদিন আপোষ করেন না। তিনি চান তার বাচ্চাদের যা খাওয়াচ্ছেন, সবাইকেই তা যেন দিতে পারেন। ২০১৯ সালে তিনি একটা আউটলেট দেন কান্দিরপাড়ে। সেখানে মোট ৫ জন কর্মী ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে কুমিল্লা থেকে ঢাকা শিফট হবার কারণে আউটলেটটি বন্ধ করে দেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার বসুন্ধরা এরিয়া থেকে হোম মেড ফুড নিয়ে কাজ করছেন ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
তার উদ্যোগের নাম ‘নুসরাত’স কিচেন’। তিনি সবসময়ই চেয়েছেন নিজের যোগ্যতায় নিজের একটা পরিচয় হবে। তাই তিনি নিজের নামেই পেইজের নাম দিয়েছেন ও কুকিং সেন্টারের নাম দিয়েছেন ‘নুসরাত’স কুকিং সেন্টার’। দেশের বাইরে তার বানানো পিঠা ও মিষ্টি পাঠাচ্ছেন। দেশের মধ্যে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্রগ্রাম, চাঁদপুরে তার পণ্য যাচ্ছে। প্রতি মাসে এখন শতাধিক মানুষের খাবার তৈরী করেন এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে কেক সাপ্লাই দেন।
উদ্যোক্তার স্বপ্ন একদিন তার উদ্যোগ অনেক বড় হবে, আর সেখানে কাজ করবে অসহায় মেয়েরা। তিনি যেসব সমস্যার সম্মুখীনন হয়েছেন তাদের যেনো তার মুখোমুখি হতে না হয় তার জন্য তাদেরকে দক্ষ করে তুলবেন বিনা টাকায় ও তাদের নিয়েই তিনি তার প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাবেন। এটাই তার প্রত্যাশা। তিনি নিজের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে কাজ করে চলেছেন। কোনভাবেই ভেঙ্গে পড়েননি। অন্যের কথা কানে নিয়ে পিছিয়ে না পড়ে নিজের কাজে ফোকাস দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।
এখন কুমিল্লায় ১০০ জনের ভেতর ৬০ জন লোকই Nusrat’s Kitchen চেনে, এটাই তার কাজের পূর্ণতা। যারা একসময় তাকে নিয়ে সমালোচনা করতেন, তারাই আজ গর্বের সাথে তার পরিচয় দেন। এটাই তার সফলতা। অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝ দিয়ে উদ্যোক্তা জীবনে আজ সফল হয়েছেন। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে জরিপে কুমিল্লার সেরা নারী উদ্যোক্তার সম্মাননা পান ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালে নিবেদিতা নামক ঢাকার গার্লস গ্রুপ জরিপের মধ্য দিয়ে বেস্ট ক্যাটারিং ক্যাটাগরিতে তাকে সম্মাননা দেয়। ২০২২ সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ উই প্ল্যাটফর্ম এর মাধ্যমে আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে তিনি সরকারি অনুদান পেয়েছেন একজন স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা হিসেবে।
স্বপ্না আক্তার,
উদ্যোক্তা বার্তা