ভাড়া বাসায় ছোট্ট একটি ঘরে হাতুড়ি ও হ্যাক্সো ব্লেড দিয়ে দেয়াল বাঁধাই তৈরীর কাজ শুরু। অল্প সময়ে পণ্যের গুণগতমান ও পরিশ্রম একজন উদ্যোক্তার জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ম্যানুয়ালি থেকে আজ মেশিনে তৈরী হচ্ছে হাজার-হাজার ওয়াল হ্যাংগিং প্রোডাক্ট ও ফ্লাওয়ার ভাস। বলা যায় উত্তরবঙ্গে এখন প্রায় একচেটিয়া বাজার তৈরী করে ফেলেছেন এই উদ্যোক্তা।
নাম মোঃ আশরাফুল ইসলাম। তার প্রতিষ্ঠান হুমায়রা আর্টস ঘরের অতি যত্নে তৈরী একেকটি ওয়ালমেট চলে যাচ্ছে নগরীর বড়-বড় শপিং সেন্টার ও আশপাশের এলাকায়।
উদ্যোক্তা জীবনে পদার্পণের আগে মূলত তিনি একজন কসমেটিক্স ব্যবসায়ী ছিলেন। পাশাপাশি তার দোকানে ওয়াল হ্যাংগিং প্রোডাক্টসও রাখতেন। অন্য প্রতিষ্ঠান হতে এই পণ্যগুলো সংগ্রহ করে বিক্রয় করতেন তিনি। এভাবে একবার পণ্য সংগ্রহ করতে ঢাকায় গেলে সেখান থেকে এক শুভাকাঙ্ক্ষী পরামর্শ দেন এভাবে কাঁচের জিনিস এত দূরে না নিয়ে রাজশাহীতেই আপনি শুরু করুন। আশরাফুল ইসলাম তখনই তার কাছে আবদার করে বসলেন- তাহলে আপনিই যেয়ে আমাকে কয়েকমাস শিখিয়ে দিয়ে আসেন, যতদিন লাগে মাসে-মাসে আপনাকে সম্মানী দেওয়া হবে আপনার চাহিদা অনুযায়ী। তিনিও রাজি হয়ে যান। পরবর্তীতে রাজশাহীতে এসে আশরাফুল ইসলামকে প্রশিক্ষণ দেন তিনি। কথা ছিল তিন মাসের প্রশিক্ষণ হলে মোটামুটি কাজগুলো আয়ত্ত্ব করতে পারবেন আশরাফুল ইসলাম। কিন্তু মাত্র ৪০ দিনে যাবতীয় কাজ আয়ত্ত্ব করে সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন এই উদ্যোক্তা। এভাবেই কসমেটিকস ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলামের জীবনে ‘দেয়াল বাঁধাই’ কার্যক্রম এর সূচনা।
তবে পণ্য গুলো যখন এক-এক করে তৈরী করতে আরম্ভ করলেন, সমস্যা শুরু হলো সেখানেই। পণ্য তৈরীর পর যখন রাজশাহীর সাহেব বাজার, নিউমার্কেটের বিভিন্ন দোকানে নিয়ে যেতেন, সকল দোকানী বলতেন ‘এই লোকাল মাল চলবে না। ফেরত নিয়ে যান। কোনোভাবেই এগুলো বিক্রি সম্ভব না।’ এভাবে ‘না’ শুনেই প্রথম দিন ফেরত এলেন, তিন দিন পর আবার গেলেন, আবারো দোকানীদের উত্তর ‘না’। ফিরে এসে মনের ভেতর জেদ সৃষ্টি করলেন– আমাকে পারতেই হবে। কয়েকদিনে আরো ভালো কিছু পণ্য রেডি করে চারদিন পর আবার পৌঁছালেন দোকানে। এক দোকানীকে বললেন, ‘এগুলো আপনারা রাখেন। যদি বিক্রি না হয় তাহলে টাকা দিতে হবে না আমি নিজেই ফেরত নিয়ে যাবো।’ সেদিন বিকেলের মধ্যেই উদ্যোক্তার দুটি দেয়াল বাঁধাই বিক্রি হয়ে গেল। এবার দোকানীই উদ্যোক্তা আশরাফুল ইসলামকে বললেন, আর ভালো প্রডাক্টস যা আছে, আগামীকাল নিয়ে আসেন। এভাবে এক দোকান-থেকে আরেক দোকান, এক মার্কেট আরেক মার্কেট, রাজশাহী থেকে আশপাশের জেলা, উপজেলা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে হুমায়রা আর্টস ঘরের বিভিন্ন সাইজের, ভিন্ন ভিন্ন কালার ও ডিজাইন সম্বলিত একেকটি ওয়াল হ্যাংগিং প্রোডাক্ট।
উদ্যোক্তা বলেন, “খুবই স্বল্প পুঁজি নিয়ে হাতুড়ি ও হ্যাক্সো ব্লেড দিয়ে আমি শুরু করেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম আমার পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, তখন ম্যানুয়ালি তৈরী করে কাজ এগোতে পারতাম না। কাজের ফিনিশিংও আমার মনের মতো হতো না। কিছুদিন পর মেশিন কিনলাম। মেশিনে কাজ শুরু করতেই নতুন অভিজ্ঞতা। আগে সারাদিনে আমি যদি ৩০টি কাজ শেষ করতাম, মেশিনে সে কাজ ৪০ মিনিটে শেষ হতো। এতে করে দৈনিক প্রডাকশন বাড়লো, পাশাপাশি কাজের ফিনিশিং মনমতো হতে শুরু করলো। একাই শুরু করা উদ্যোগে এখন আমার সাথে তিনজন কাজ করছেন। হাতুড়ি থেকে এখন আমার পাঁচটি মেশিন রয়েছে। আমার পরিকল্পনা রয়েছে আমার এই পণ্যগুলো একসময় সারা বাংলাদেশে পৌঁছে যাবে। এতে আরো অনেকের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। “
তিনি বলেন: যারা উদ্যোক্তা হতে চান বা হয়েছেন, তাদের শুধু একটা পরামর্শই আমি দেবো– আমাদের চলার পথে সমস্যা সৃষ্টি হবে বার-বার। আমাকে বহুবার দোকানীরা দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি কিন্তু ‘না’ শুনে থেমে থাকিনি, লেগে থেকেছি। আবারও তাদের দুয়ারে গেছি। একসময় তারা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। আমিও পণ্যের কোয়ালিটি ধরে রেখেছি। আজ সে দোকানে আমাকে আর যেতে হয় না, তারাই আমার প্রতিষ্ঠানে এসে পণ্য সংগ্রহ করে। নতুনরাও যেন ‘না’ শুনে থেমে না যায়- এটাই আমার চাওয়া।
তামান্না ইমাম
উদ্যোক্তা বার্তা