নরসিংদীর শিবপুর ও বেলাব উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ গাছের ডগা থেকে গোড়া পর্যন্ত শাখা-প্রশাখায় থোকায় থোকায় ঝুলে আছে টক-মিষ্টি স্বাদের পাকা লটকন। এক সময়ের কদরহীন ঔষধি গুণসম্পন্ন লটকন এখন জেলার অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর পরিমাণে রফতানি হচ্ছে লটকন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, জেলার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পাওয়া লটকন এখন অন্তত সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বাজার।
জেলায় এবার সবচেয়ে বেশি লটকনের আবাদ হয়েছে শিবপুর উপজেলার জয়নগর এলাকায়। এ বছর প্রকার ও আকারভেদে প্রতি কেজি লটকন ৭০ থেকে ২০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। চলতি মৌসুমে জেলাজুড়ে লটকনের ফলন ও দাম, উভয়ই ভালো পাওয়ায় চাষিরাও বেশ খুশি।
প্রতিদিন ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত জেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মরজাল, চৈতন্যা ও বারৈচা এলাকায় লটকনের হাট বসে। এসব হাটে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে অন্তত কয়েক কোটি টাকার লটকন। এসব হাট থেকে কেনা লটকন ট্রাকের পর ট্রাকে করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেন পাইকাররা। এ ছাড়াও দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হচ্ছে লটকন।
লটকন চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত বছর আগে শিবপুরের জয়নগর এলাকার বনে-জঙ্গলে লটকন গাছ দেখা যেত। সে সময় থেকেই স্থানীয়দের কাছে ফলটির কোনো অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল না। অযত্নে বেড়ে ওঠা লটকন গাছ একটি-দুটি করে শিবপুর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী বেলাব উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বছর দশেক আগে থেকে সারা দেশে সুস্বাদু লটকনের সুনাম ছড়িয়ে পড়লে শত শত বাগানে বাণিজ্যিক চাষের প্রবণতা শুরু হয়।
এখনতো পাইকাররা আগেই কৃষকের বাগান এক মৌসুমের জন্য কিনে নেন। বর্তমানে এই দুই উপজেলায় প্রধান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে লটকন। এক মৌসুমে লটকন বিক্রির টাকায় সারা বছর সংসার চালান, এমন পরিবারের সংখ্যা এখন অনেক। স্থানীয় ভাষায় লটকনকে বুবি বা গোডা বলা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জেলায় ১৯শ’ হেক্টর জমিতে লটকন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শিবপুরে ১৬শ’, বেলাবতে ৩১০, রায়পুরায় ৫০ ও মনোহরদীতে ৪০ হেক্টর জমিতে হয়েছে লটকনের আবাদ। মোট আবাদের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিকটন।
এসব লটকনের বাজারমূল্য অন্তত সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। এ থেকে চাষিরা লাভবান হবেন ২০০ কোটি টাকার মতো। আড়াই হাজার মেট্রিকটনেরও বেশি লটকন রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
চলতি মৌসুমে জেলাজুড়ে লটকনের ফলন ও দাম, উভয়ই ভালো পাওয়ায় চাষিরাও বেশ খুশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, লটকনে অধিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও আয়রন আছে; যা আর্থ্রাইটিস, পাকস্থলির আলসারসহ বিভিন্ন ত্বকের সমস্যা সমাধানে কাজে দেয়। রুচি বাড়াতে এবং মানসিক অবসাদ দূর করতেও ফলটি উপকারী। লটকনগাছের পাতা গুঁড়া করে খেলে ডায়রিয়া এবং ডাল ও বাকল চর্মরোগের উপশম করে।
সরেজমিনে কয়েকটি লটকনের বাগান ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে ঝুলে আছে থোকা থোকা পাকা লটকন। হলুদ হয়ে আছে একেকটা গাছ। অনেক গাছে গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত এমনভাবে ফল ধরে যে ডালও দেখা যায় না।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুইপাশে ঝুপড়ি দোকানে অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি জায়গায় নিজের গাছের লটকন বিক্রি করতে দেখা গেছে কৃষকদের। এর মধ্যে মরজাল, বারৈচা ও চৈতন্যা এলাকার হাটে স্থানীয় কৃষকরা ভোর থেকেই ভ্যানে করে নিজেদের বাগানে আবাদ করা লটকন নিয়ে আসেন।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পাইকাররা দরদাম করে কিনে নেন এসব লটকন। এ বছর প্রকার ও আকারভেদে প্রতি কেজি লটকন ৭০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
পাইকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিক্রি হওয়ার পর বেতের ঝুড়িতে ১০ বা ২০ কেজি বা প্লাস্টিকের বস্তায় ৫০ কেজি লটকন ভরে পর্যাপ্ত পানি ছেটানো হয়। পরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানোর জন্য ট্রাক বা ছোট-বড় পিকআপ ভ্যানে তোলা হয়। এভাবেই এসব লটকন ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ও দেশের বাইরে।
শুধু মরজাল হাটেই প্রতিদিন তিন থেকে চার কোটি টাকার লটকন বিক্রি হয়। আর সব হাট মিলিয়ে প্রতিদিন বিক্রি হয় আট থেকে দশ কোটি টাকার লটকন।
নরসিংদীর লটকনের সঙ্গে এলাকার হাজারো পরিবারের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়রা জড়িয়ে আছেন। এই লটকনকে কেন্দ্র করে যে বাজার সৃষ্টি হয়েছে তাকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছেন সংশ্লিষ্টরা। বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা এক সিজনের আয় দিয়েই পুরো বছর চলার মতো অর্থ পেয়ে যান।
শিবপুর উপজেলার চৈতন্য এলাকার লটকন বাগানে কথা হয় ইমান আলী সরকার নামের একজন লটকনচাষির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লটকন চাষে তুলনামূলকভাবে খরচ কম, শ্রমও দিতে হয় কম। আমি ৩০ বছর ধরে লটকন চাষ করছি। লটকন চাষ করতে করতে আমরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি। আমরা বাগানের লটকন বিদেশেও যায়। তার জন্য ভালো মানের লটকন বাছাই করে ৪০০ গ্রাম করে পলিথিনের প্যাকেট করে ঢাকার শ্যামবাজারে পাঠাই। সেখান থেকে তারা পরীক্ষা করে বিদেশে পাঠায়।
বেলাব উপজেলার জিরাব এলাকায় লটকন বাগানে কথা হয় কাজল মিয়া নামের একজন লটকনচাষির সঙ্গে। তিনি বলেন, রোপণের তিন বছরের মধ্যে লটকন গাছে ফল আসে। একটি গাছে টানা ২৫-৩০ বছর ফলন হয়। লটকন গাছের তেমন রোগবালাই নেই। পরিচর্যাও করতে হয় কম। গাছে ফল কাঁচা থাকা অবস্থাতেই পাইকাররা বাগান কিনে নেন। অন্যান্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ হয় লটকনে। চলতি বছরে এই পর্যন্ত ১৮ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করেছি, আরও ৭-৮ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবো।
নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে নরসিংদীর ব্র্যান্ডখ্যাত লটকনের সুনাম। দেশ-বিদেশের বাজারে চাহিদা থাকায় এবং অল্প খরচে বেশি লাভজনক হওয়ায় বেশিরভাগ কৃষকই বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ করছেন। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবেন নরসিংদীর কৃষকেরা।
ডেস্ক রিপোর্ট,
উদ্যোক্তা বার্তা