দেশের মাটিতে সৌদি আরবের আজওয়া খেজুর

0

বাংলাদেশে খেজুরের জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা বিপুল। একটা সময় পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল শুধু বিদেশি খেজুর, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে আসা খেজুর। স্থানীয়ভাবে চাষিদের কাছে এসব খেজুর ‘আরবি খেজুর’ বা ‘সৌদি খেজুর’ নামে পরিচিত। কেবল রোজার মাসকে উপলক্ষ করে টনকে টন খেজুর আমদানি হত প্রতি বছর। স্থানীয় বাজার এবং সুপার শপে এখন বছরজুড়ে এই খেজুর পাওয়া যায়। গত কয়েক বছর ধরে সেই সৌদি আরবের বিভিন্ন জাতের খেজুর বাংলাদেশেই চাষ হচ্ছে।

মানিকগঞ্জ:
কৃষি গবেষকেরা বলছেন, মূলত মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত ধরেই দেশে সৌদি খেজুরের উৎপাদন শুরু। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ যারা শুরু করেছেন, শুরুর দিকে তাদের প্রায় সবাই সৌদি আরব থেকে বীজ এবং চারা এনে গাছ লাগিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে প্রথম যারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সৌদি খেজুর চাষ শুরু করেন তাদের একজন মানিকগঞ্জের শেখ মোহাম্মদ আব্দুল হালিম। মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ২০১৪ সালে তিনি প্রথম উৎপাদন শুরু করেন।

বাংলাদেশে কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ সালের দিকেই বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের চাষ শুরু হয়।

আব্দুল হালিম শুরুতে সৌদি আরব থেকে বীজ এনে চারা তৈরি করেন। আর এখন গাছ থেকে ‘অফস্যুট’ করা হয়, মানে গাছ থেকে নতুন চারা তৈরি করা হয়। বাজারে দেশি খেজুরের জনপ্রিয়তা কম, তাই সৌদি খেজুরের কথা চিন্তা করেন তিনি।

যশোর:
সৌদি আরবের আজওয়া সুমিষ্ট খেজুর চাষ করে সফল হয়েছেন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার নির্বাসখোলা ইউনিয়নের বেড়ারো পানি গ্রামের কৃষক বাবুল হোসেন। ইউটিউবে সৌদির আজওয়া খেজুর চাষ পদ্ধতি দেখে এই খেজুর চাষে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। পরে কৃষক বাবুল হোসেন এক নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছুসংখ্যক সৌদির পাকা আজওয়া খেজুর সংগ্রহ করেন। পরীক্ষামূলকভাবে খেজুরের বীজ নিজের দুই বিঘা জমিতে রোপণ করেন। গাছ বেঁচে যাওয়ায় নিজের জমিতে সৌদির খেজুরের বাণিজ্যিক চাষের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন বাবুল হোসেন। বর্তমানে তিনি দুই বিঘা জমিতে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ শতাধিক খেজুর গাছ রোপণ করেছেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি গাছে ফল আসতেও শুরু করেছে। খেজুরের ব্যবসায়ীদের কাছে ফলন ধরা এক একটি খেজুর গাছের দাম উঠেছে এক লাখ টাকা করে।

এ বিষয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি সমপ্রসারণ অফিসার আব্দুল্লাহ আল- মামুন বলেন, ইতিমধ্যে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাবুল হোসেনের আজওয়া খেজুরের বাগান পরিদর্শন করেছেন। আমরা তাকে সার্বিক সহোযোগিতা করার জন্য চেষ্টা করছি। বিষয়টি সচিত্রভাবে আমাদের কৃষি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। বাবুল হোসেনের দেখাদেখি অনেকেই স্বপ্ন বুনছেন যশোরের মাটিতে সৌদি খেজুরের বাণিজ্যিক চাষ করার।

ঝিনাইদহ:
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের যুবক মোস্তাক আহমেদ লাবলু। ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করা শিক্ষিত যুবক লাভলু কালীগঞ্জ পৌরসভার আড়পাড়া গ্রামে বসবাস করেন। মোস্তাক আহমেদ লাভলু জানান, ২০১৭ সালে তিনি একটি টেলিভিশনের মাধ্যমে আজওয়া খেজুরের ঐতিহাসিক কাহিনী জানতে পারেন। তখন নিজেই সৌদি আরব থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিজেই চারা তৈরি করেন। এরপর ২০১৭ সালে সৌদি আরবে অবস্থানরত রানা নামে তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ২৫টি আজওয়া খেজুরের বীজ সংগ্রহ করেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি ১৯টি চারা তৈরি করেন, কিন্তু ১২টি চারা বাঁচে। বাকি সাতটি মারা যায়। এরপর ২০১৮ সালে আবার সৌদি আরব থেকে আজওয়া খেজুরের বীজ সংগ্রহ করেন। সেখান থেকে তিনি ১০০টি চারা উৎপাদন করেন।

সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ১২৫টি চারা উৎপাদন করেন। এরপর তিনি কালীগঞ্জ উপজেলার পাতিবিলা ও চাচড়া গ্রামের মাঠের একটি পুকুর পাড়ে ‘মোস্তাক অ্যান্ড মোস্তাফিজ আজওয়া খেজুর বাগান প্রজেক্ট’ নামে খেজুরের চারা তৈরির কাজ শুরু করেন।

নওগাঁ:
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার পারইল ইউনিয়নের বিলকৃষ্ণপুর ধোপাপাড়া গ্রামের আব্দুল মজিদ প্রায় ২০ বছর সৌদি প্রবাসী ছিলেন। সেখানে থাকা আবস্থায় ইউটিউবে খেজুর চাষের ভিডিও দেখে বাংলাদেশে এটি চাষে উদ্বুদ্ধ হন। দেশে আসার সময় সেখান থেকে মরিয়ম ও আজওয়া জাতের খেজুরবীজ নিয়ে আসেন।

সেই বীজ দিয়ে ৩০ শতাংশ জমিতে রোপণ করেন খেজুর গাছ। বর্তমানে তার বাগানে ৭০টি গাছ রয়েছে। বাগান ঘুরে দেখা যায়, ৩০ শতাংশ জমিতে শতাধিক সারি সারি খেজুর গাছ। প্রতিটি গাছ প্রায় ছয়-সাত ফুট লম্বা। ইতোমধ্যে কয়েকটি গাছে ফলও আসতে শুরু করেছে। 

বগুড়া:
বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলায় সৌদি আরবের বিখ্যাত আজওয়া জাতের খেজুর চাষ করে সফলতা পেতে শুরু করেছেন মো. আবু হানিফা নামে এক কৃষি উদ্যোক্তা। সৌদি খেজুর চাষের এই সফলতাকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কৃষিক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে কৃষি বিভাগ।

প্রায় ৯ শতক জায়গার ওপর লাগানো ১৬টি আজওয়া খেজুর গাছের মধ্যে বেঁচে আছে ১৩টি। জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে শেরপুর, নন্দীগ্রাম ও কাহালুতে অনেক কৃষক নিজ উদ্যোগে খেজুর গাছ লাগিয়েছেন।

আবু হানিফা ২০১৮ সালে হজ করে আসার সময় সৌদি থেকে আজওয়া খেজুর এনে সেগুলোর বীজ সংরক্ষণ করেন এবং টবে চারা তৈরি করেন। ২০২০ সালে ৯ শতক জায়গার ওপর ১৬টি চারাসহ মাল্টা, আপেলকুল, বারোমাসি আম, বারি ফোর, কিউজাই, মিষ্টি তেঁতুল, কামরাঙ্গা, আলুবোখারার গাছ লাগিয়েছেন। এছাড়াও ১ বিঘা জমিতে লিচু, বিভিন্ন জাতের আম, পেঁপে, সফেদা, গোলাপজাম, দারুচিনি, জামরুল লাগিয়েছেন। এ যেন এক মন-মাতানো দৃশ্য, সবুজের বুকে অন্য রকম সবুজ। এক জমিতে বিভিন্ন জাতের ফল চাষ করায় ব্যাপক সাফল্যের স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

আবু হানিফা জানান, শখের বসে চারা করেছিলেন আজওয়া খেজুরের। মাত্র ৯ শতক জায়গার ওপর ১৬টি আজওয়া খেজুরগাছ লাগিয়েছিলেন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। বেঁচে আছে ১৩টি গাছ। সেই গাছগুলোর মধ্যে একটিতে প্রায় ২৭-২৮ মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম খেজুর বের হয়। চার মাসে বড় হয়ে থোকায় থোকায় খেজুর ধরেছে ও রং পরিবর্তন হয়ে সবুজ থেকে পাকতে শুরু করে লালচে রং ধারন করেছে। আর কিছু দিনের মধ্যে পুরোপুরি খাওয়ার উপযোগী হয়ে যাবে। এখন গাছে যে দুটি থোকায় খেজুর ধরেছে তাতে আনুমানিক ৬-৭ কেজি খেজুর পাওয়া যেতে পারে। পরের বছর এর চেয়ে তিন গুণ বেশি খেজুর পাওয়া যাবে।

গাইবান্ধা:
বাজারে সৌদি আরবের খেজুর খেয়ে সেই বীজ সংরক্ষণ করে প্রথমে বপন করেন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জাহিদুল ইসলাম। সেই থেকে শুরু। এরপর হজে গিয়ে সেখান থেকেও আজওয়া, খোরমা, বারিহী, মরিয়মসহ কয়েক জাতের খেজুর গাছের চারা আনেন তিনি। খেজুরের বাগানের পাশাপাশি ১৮ বিঘা জমিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফলের বাগান ও নার্সারি করেছেন জাহিদুল ইসলাম।

ইতোমধ্যে তার খেজুর বাগানের গাছে দেখা দিয়েছে ফলন। খেজুর গাছের চারা বিক্রি করে তিনি এখন স্বাবলম্বী।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রিকালচারাল বোটানি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রেজওয়ানা নিজাম বলেছেন, মূলত দুইটি কারণে বাংলাদেশে সৌদি খেজুরের চাষ দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এক, বাংলাদেশের আবহাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক উষ্ণ হয়ে উঠেছে, অর্থাৎ গ্রীষ্মের ভাব বেশি সময় ধরে থাকে, যে কারণে সৌদি আরবের আবহাওয়া সহিষ্ণু ফল এখানে এখন সহজে চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।

দুই, বাংলাদেশের মাটিতে এখন আগের চেয়ে লবনাক্ততার পরিমাণও অনেক বেড়েছে, যে কারণে এ ফলের ফলন ভালো হচ্ছে।

মূলত সেকারণেই দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সৌদি খেজুর চাষ দ্রুত খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

আরেকটি কারণ হচ্ছে খেজুর গাছ সাধারণত সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়।

যদিও বেলে ও বেলে-দো-আঁশ মাটিতে সহজে চাষ করা যায় এই খেজুর। কেবল নিশ্চিত করতে হবে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা যেন থাকে।

এখন কেবল মানিকগঞ্জ নয়, মাগুরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের প্রায় ২০টি জেলায় এ খেজুর বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে, বিশেষ করে যেসব জায়গায় মাটি বেলে এবং দো-আঁশ ধরণের সেখানে।

সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here