উদ্যোক্তা হওয়ার শুরুটা হয়েছিলো ২০০৯ সালের দিকে। প্রথমে ব্লক ও বাটিকের থ্রি-পিস নিয়ে কাজ শুরু। কাজ করতে গিয়ে তরুণ উদ্যোক্তা দেশের মানুষের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য করতে গিয়ে দেখেন অধিকাংশ মানুষ দেশীও পণ্যের মাঝে একটু নতুন, একটু বৈচিত্র্যতা খুঁজছেন। তাই দেশীও পণ্যের ওপর আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য উদ্যোক্তা ভিন্ন কিছু চিন্তা শুরু করেন। যার সফলতা আজকের ‘রাহেলা জুট ক্রাফটস’। ভিন্ন কিছু পরিবর্তনের এই ভাবনা থেকে ২০১১ সালে ‘রাহেলা জুট ক্রাফটস’ নামে পাটজাত পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। যা তাকে আজ একটি সুদৃঢ় অবস্থানে আসতে সাহায্য করেছে।
উদ্যোক্তা বার্তায় এবার পরিচয় করাবো একজন নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে যিনি বাংলাদেশে তৈরিকৃত পাটপণ্য নিয়ে কাজ করে সফলতা অর্জন করেছেন। উদ্যোক্তার নাম শামীম আরা দীপা।
উদ্যোক্তা শুরুর দিকে একটি সেকেন্ড হ্যান্ড মেশিন দিয়ে পাটজাত পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে উদ্যোক্তা প্রচলিত বাজার থেকে ফেব্রিকস কিনে নিজের পছন্দমত বৈচিত্র্যময় ডিজাইন ও কাটিং করে নিজেই সেলাই করতেন। পরে নিজেই পাটজাত পণ্য নিয়ে বাজারে যেতেন বিক্রি করতে।
ঝিনাইদহের মেয়ে দীপা। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে শুরুর দিকে অনেক চড়াই-উতরাই পাড় করতে হয়েছে। সামাজিকভাবে নানাবিধ বাধার মুখে পড়তে হয়। শুরুতে তার কাজের বিষয়টি অনেকে একটু বাঁকা চোখেই দেখতো। তবু তিনি দমে যাননি। সমাজে সবার কুদৃষ্টি উপেক্ষা করে এবং নিজ পরিবারকে বুঝিয়ে মানিয়ে নিজের লক্ষ্যে স্থির ছিলেন দীপা।
২০১২ সালে ‘রাহেলা জুট ক্র্যাফট’ নামে পাটজাত পণ্য তৈরির কাজ শুরু করেন। আমাদের দেশে শুরু থেকে পাটপণ্যের চাহিদা ছিল ব্যাপক। রাহেলা জুট ক্র্যাফট সাধারণত যেসব পাট জাত পণ্য তৈরি করে থাকে তার মধ্যে অন্যতম মেয়েদের ফ্যাশনেবল ব্যাগ, টিস্যু বক্স কভার, কুশন কভার, শাড়ি, ব্যাগ, পার্স, সাইড ব্যাগ, ব্যাগ প্যাক, স্কুল ব্যাগ, অফিস ব্যাগ, ফাইল ফোল্ডার, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, চটি, স্যান্ডেলসহ নানা অত্যাধুনিক পণ্য। বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতায় ব্যবহার করেন কটন, জরি, জামদানি, ব্লক, বাটিক এমনকি করেন হ্যান্ডপ্রিন্টও। পাটের ফেব্রিকস দিয়ে যে বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতা সব পণ্য তৈরি করা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাহেলা জুট ক্র্যাফট।
নিজ জেলা ঝিনাইদহে গড়েছেন নিজের কারখানা। সেখানে ১৪ টি মেশিনে পাটজাত পণ্য তৈরি করা হয়। এই কারখানায় এখন রয়েছে অসংখ্য বেতনভুক্ত কর্মী। দীপা ভালো ও পরিবেশবান্ধব পণ্যের মানোন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন।
নিরলস সততাপূর্ণ পরিশ্রম, মেধা, ঐকান্তিকতা ও একাগ্রতার সঙ্গে রাহেলা জুট ক্র্যাফট নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা শামীম আরা দীপা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ রাহেলা জুট ক্র্যাফটকে শুরুর ১৫ হাজার টাকার মূলধন থেকে উন্নীত করেছেন ২০ লাখ টাকায়।
সফল উদ্যোক্তা শামীম আরা দীপা দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত পাট ও বস্ত্র পণ্যের সব মেলায় সবসময় অংশগ্রহণ করেন। দেশের বাণিজ্য মেলা, পাট মেলা, জেডিপিসির মেলা, বস্ত্র মেলা, এসএমই মেলা, বিসিক মেলাসহ নানা ধরনের মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। দেশের বাইরেও আয়োজিত মেগা ট্রেড ফেয়ার ও বাণিজ্য মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন।
এ বিষয়ে উদ্যোক্তা শামীম আরা দীপা বলেন, আমার এখন পর্যন্ত নিজের কোনো শোরুম নেই। তাই পণ্য বিক্রির প্রধান স্থান হলো বিভিন্ন মেলা। মেলা থেকেই আমি যথেষ্ট আয় করতে পারি। তা ছাড়া মেলার মাধ্যমে খুচরা বিক্রির পাশাপাশি বড় বড় অর্ডারও পাওয়া যায়। তাই আমি দেশের বড় পরিসরের প্রত্যেকটি মেলাতেই অংশগ্রহণ করি।
উদ্যোক্তা তার কর্মময় জীবনে পাটজাত পণ্য তৈরি করে যেমন সুনাম অর্জন করেছেন, তেমনি পরিবেশবান্ধব পাটের পণ্য বানিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছেন সর্বমহলে। সেই সঙ্গে সময়ের পথ ধরে পেয়েছেন সম্মাননাও। জেডিপিসি থেকে সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সম্মাননা ও ক্রেস্ট পেয়েছেন পাট মেলায়। মাগুরা থেকেও পেয়েছেন সেরা উদ্যোক্তার সম্মাননা। শামীম আরা দীপা বর্তমানে মহিলা উইম্যান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্টির সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উদ্যোক্তা যুক্ত আছেন।
দেশের নারী উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে উদ্যোক্তা বলেন- জীবনে চলার পথে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। এর কিছু আপনাদেরকে বলতে চাই। তাহলো, যখন আপনি ব্যবসায় শুরু করছেন তখন আপনার যা আছে তা দিয়েই শুরু করুন। আমি বলবো কাজকর্মের দেখভাল করা এবং যোগাযোগ ব্যবসার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ জন্য, ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করাটাই ভালো। চলতে পথে নানা প্রতিবন্ধকতা আসবে। আর দক্ষভাবে এসব সামলে আপনি যা অর্জন করবেন তা অমূল্য।
‘কিছু নারী আছেন যারা এখনো নির্দিষ্ট চাকরির দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমার মনে হয়, এটা একটা বড় ধরণের সমস্যা। তারা ভুলে যান যে, বিশ্বের বেশিরভাগ সফল ব্যবসায় খুব ছোট আকারে শুরু হয়েছিলো। আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারি তবে বিশ্বের সব জায়গাতেই নারীর ক্ষমতায়ন ঘটবে। আমাদের আশপাশে অসংখ্য সুযোগ ছড়িয়ে আছে। এসবের সঠিক ব্যবহার করলে আমাদের জীবন পাল্টে যেতে পারে’।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা