সামাজিক উদ্যোক্তা শারনিলা নুজহাত কবির

‘পানির অপর নাম জীবন’ কথাটি আমরা ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি কিন্তু কথাটি বোধ হয় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে বলা উচিৎ ‘বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন’। কারণ জীবাণুযুক্ত পানি পান মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে। আর এই ব্রত নিয়েই কাজ করছেন তরুণ উদ্যোক্তা শারনিলা নুজহাত কবির।

উন্নয়ন বা সেবামূলক কাজের প্রতি ছোট থেকে শারনিলার ভীষণ ভাল লাগা কাজ করতো। পরিবেশবিদ বাবা প্রায় ৩০ বছরেরও অধিক সময় নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছেন। ছোটবেলায় নিজের প্রজেক্টের কাজ দেখানোর জন্য বাবা শারনিলাকে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে যেতেন। যেদিন শারনিলা যেতেন না,বাবা সেদিন বাড়ী ফিরে গল্প করতেন এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন যেন মেয়েও এমন কাজে উৎসাহিত হয়ে মানবীয় গুন সম্পন্ন একজন মানুষ হয়।

শারনিলা সানবিমস্ স্কুলে পড়াশোনার পর ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি (আইইউবি), বাংলাদেশ  থেকে ‘Environmental science ‘ পরিবেশ বিজ্ঞানের ওপর স্নাতক শুরু করেন ২০১৮ সালে। বলা যায় ১২বছর বয়স থেকে শারনিলা এমন সব মানবীয় কাজের সাথে যুক্ত আর কাজ গুলো করতে তার এতো ভালো লাগে যে বিদেশে স্নাতক সম্পন্ন করার সকল আয়োজন পণ্ড করে দেশ প্রেমে, দেশের মানুষের জন্য থেকে গেলেন। বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করলেন।

২০১৪ সালে প্রথম শারনিলা ফুটস্টেপস সম্পর্কে জানতে পারে এবং সেসময় তাদের একটা শীত বস্ত্র বিতরণ ক্যাম্পে অংশ নিয়েছিল। ২০১৫ তে সেখানে ফুল টাইম স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ৪ বছর পরে সে ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য এবং হেড অব পার্টনারশিপ হয়ে যান।

ফুটস্টেপ বাংলাদেশ মূলত সমাজ উন্নয়ন মূলক একটা সামাজিক সংস্থা। সমাজে কি কি সমস্যা আছে সেগুলো নিরূপণ করে থাকেন। যেখানে “প্রজেক্ট তৃষ্ণা” কাজ করছেন নিরাপদ পানি নিয়ে।

নিরাপদ খাবার পানি সংকট এই সমস্যা বাংলাদেশ নতুন নয়। ২১ মিলিয়ন মানুষ দেশে এই সমস্যার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে যার মধ্যে ৬ মিলিয়ন শুধু ঢাকাতেই। এসব দেখে ২০১৫ সালে ফুটস্টেপ শুরু করে “প্রজেক্ট তৃষ্ণা” যা উন্মুক্ত স্থান গুলোতে পানি বিশুদ্ধ করণ ফিল্টার এবং পুরো সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে পথচারী এবং রিকশা চালকদের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ করছে।

তারপর ২০১৮ সালের আগস্টে “প্রজেক্ট তৃষ্ণা” শুরু করেন স্বল্প আয়ের শিশু এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পানি প্রদান যেন তারা ডায়রিয়া, আমাশয় ইত্যাদি পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত না হয় এবং স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত হতে পারে। এই প্রজেক্টগুলো চলতো বিভিন্ন ব্যক্তির অর্থায়নে। এখন এই প্রজেক্টে ২০ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে সহায়তা করছে। যাদের মধ্যে রয়েছে সিটি ব্যাংক লিমিটেড এবং ব্যুরো বাংলাদেশ যারা সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে।

২০১৫ সাল থেকে প্রজেক্ট তৃষ্ণা অনেক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। প্রায় ৩৫টি সিস্টেমে ২টি মডেলের উপর ভিত্তি করে নিয়মিত ৩০ হাজারেরও অধিক মানুষকে নিরাপদ পানি পৌঁছে দিচ্ছেন।

বর্তমানে ঢাকার টঙ্গী থেকে দক্ষিণের শ্যামপুর এর মধ্যে ২৫ টি স্কুলের প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারছেন প্রজেক্ট তৃষ্ণা’র মাধ্যমে। সেই স্কুলের শিক্ষরা জানিয়েছেন কম করে হলেও ১০% উপস্থিতি বেড়েছে প্রতিটি ক্লাসে। শুধু তাই না অভিভাবকরা এবং স্কুলের আশেপাশের মানুষজনও এসে সেই পানি সংগ্রহ করছে প্রতিদিন তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য। যেটাতে অনেক পরিবার খুব উপকৃত হচ্ছে।

শারনিলা উদ্যোক্তা বার্তা কে জানান, ‘আমরাই যদি আমাদের জন্য না করি, তাহলে কে করবে ? প্রতিনিয়ত আমরা নতুন নতুন এলাকায় যাই এবং খুঁজে বের করি কোথায় একটা নিরাপদ পানির বিশুদ্ধ করণের ফিল্টার স্থাপন করা যায়। খুব খুশি লাগে যখন দেখি কোন পরিবার বা কিছু মানুষ এই পানি পান করে সুস্থ আছে। বর্তমানে আমাদের পরিকল্পনা সকল গার্মেন্টস কর্মীদের এই সেবার আওতাধীন করা। আর সে জন্য আমাদের পার্টনার প্রয়োজন যেন সফল ভাবে নিরাপদ পানি সংকট নিরসনের এই উদ্যোগ চালিয়ে যেতে পারি’।

শারনিলা আরও বলেন, ‘প্রতিদিন আমি শিখছি আমাদের দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে, সুবিধা বঞ্চিত ছোট ছোট শিশুদের থেকে এবং তখন আমি ভাবি আমি কতোটা ভাল আছি। আসলে আমি নিজেই নিজেকে অনুপ্রেরণা দেই কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যেতে।’

ফুটস্টেপে কাজের পাশাপাশি ছুটির সময় গুলোতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন উদ্যোক্তা শারনিলা নুজহাত কবির, কিভাবে তরুণদের আরও বেশী সমাজ সেবার কাজে উৎসাহিত করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা প্রদান করা হয় যেনো তারা সামাজিক সেবা মূলক উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী হয়।

সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করায় সাম্প্রতি ওয়াই গ্যাপের (Y-gap) এক প্রতিযোগিতায় সারাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা হাজার হাজার প্রতিযোগিদের মধ্যে সামাজিক উদ্যোক্তা শারনিলা নুজহাত কবির প্রথম ১২তে স্থান করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের সামাজিক উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি দিতে এবং তাদেরকে এগিয়ে নিতে ওয়াই গ্যাপ (ygap) কাজ করে চলেছে ২০১৬ সাল থেকে। এ পর্যন্ত তারা প্রায় ৭৫ জন সামাজিক উদ্যোক্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

বিপ্লব আহসান
স্পেশাল করেস্পন্ডেন্ট ,উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here