যে গ্রামে একসময় কাজ ছিল না, সেই গ্রামে দিন-রাত এখন কানে বাজে খেলনা তৈরির খটখট শব্দ। বাড়ির নারী ও কিশোরীদের কাঠিতে রং লাগানো ও কাগজে আলপনা আঁকার মেলা বসে প্রতিটা বাড়ির উঠানে। উঠানে চলছে কাঠ, বাঁশ আর কাগজ দিয়ে শিশুদের রংবেরঙের টমটম গাড়ি বা টরটরি গাড়ি, কাঠের গাড়ি, কাঠের চরকা, কাঠের পাখি, বেহালা, সারিন্দা, ঘিন্নিসহ হরেক খেলনা তৈরির উৎসব। কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় প্রতিবছর বৈশাখী উৎসব ঘিরে।বর্তমানে সাতটি কারখানাসহ খোলাশের প্রায় দুই শ ঘরে তৈরি হচ্ছে শিশুদের খেলনা। টমটম গাড়ির মাটির খুড়ি ও চাতকি তৈরি হচ্ছে পাশের চেঙ্গাপালপাড়া গ্রামে। সব মিলিয়ে খেলনা তৈরির এ পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ।
ষাটের দশকে তিন কারিগরের হাত ধরে খোলাশ গ্রামে খেলনা তৈরির যে বিপ্লব শুরু হয়েছিল, সেই কারিগরেরা একসময় নিজেরাই সারা দেশের আনাচে-কানাচে এ পণ্য ছড়িয়ে দিতেন। নারীরা বাড়িতে খেলনা তৈরি করতেন আর পুরুষেরা তা নিয়ে ছুটতেন বড় বড় মেলায়। ঢাকার আজিমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের লালদীঘি জব্বারের মেলা, সান্যাল ফকিরের মেলা, দোহারের নুরুল্যাপুর মেলা, কুষ্টিয়ার লালনের মেলা, ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া মেলা, দিনাজপুরের চরকাই এবং বগুড়ার পোড়াদহ মেলায় প্রচুর খেলনা বিক্রি হতো। বর্তমানে এসব মেলার পাশাপাশি রমনার বটমূলের মেলাসহ বৈশাখী মেলাগুলোতে এসব খেলনার প্রচুর কদর। পাইকারেরা এসেও এখান থেকে খেলনা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বগুড়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে দুপচাঁচিয়া উপজেলা সদর। সেখান থেকে কাঁচা-পাকা মেঠোপথ ধরে চার কিলোমিটার দূরে খোলাশ গ্রাম।
খোলাশ গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে, কেউ খেলনা হাতলের জন্য আনা কাঠ ও বাঁশের কাঠিতে রং লাগাচ্ছেন, কেউ রংবেরঙের কাঠি রোদে শুকাচ্ছেন, কেউ বাঁশ দিয়ে টমটম গাড়ির চাতকি বানাচ্ছেন, কেউ চাতকিতে রং লাগাচ্ছেন, কেউ সিমেন্টের মোটা কাগজ কাটছেন, নারী ও শিশু কারিগরেরা সেসব কাগজে আলপনা আঁকছেন, কেউ তৈরি শেষে খেলনা টমটম গাড়ি বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখছেন।
ছোট শিশুরা মেলায় গেলেই পছন্দের খেলনা টমটম কিনে দিতে হবে। আর যারা বড় হয়ে গেছে তাদেরও মনে পরে ছোটবেলার সেই খেলনা গাড়ি টমটমের কথা।
গ্রামীণ মেলার প্রধান আকর্ষণ শিশুদের খেলনা টমটম মনে করিয়ে দেয় বাঙালির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। বিশেষ করে বাংলা নববর্ষে শহর ও গ্রামের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা শুরু হলে দেখা মিলে এই খেলনার।
তবে বগুড়ার ব্যবসায়ী ও কারিগরদের দাবি, দেশের মধ্যে শুধু বগুড়া জেলাতেই টমটম খেলনা তৈরি করা হয়।
বাড়ির উঠানে পুরুষরা বাঁশের কাঠি তৈরি করছেন আর নারীরা মাটির খুড়িতে কাগজের প্রলেপের সঙ্গে রং দিয়ে আঁকছেন নকশা। ছোট্ট এ খেলনা বানাতে একজন কারিগরকে গড়ে ২০ বারের বেশি হাত বদল করতে হয়। গভীর মনোযোগ আর দক্ষতার সঙ্গে শুধু হাত ব্যবহার করেই বানানো হয় হাজার হাজার খেলনা। যুগের পর যুগ পার হলেও কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এ কাজে।
নারী কারিগরদের কর্মব্যস্ততায় সারা বছর মুখর থাকে এ গ্রাম। খেলনা তৈরি করেন তাহেরা বিবি। তিনি বলেন, হামার দুই বেটা এক বেটি, হামি প্রায় ৩০ বছর ধরে এই কাম করি,এই খেলনা বানেই বেটিক বিয়া দিসি,হামার স্বামী ঘরত পড়ে আছে,কামায় করা পারেনা,বেটারা হামার খবর লেয়না, হামিই নিজে সংসার চালায় এই খেলনা ব্যানে। ১ হাজার খেলনা বানে পাই ৭০ টেকা,হামি প্রতিদিন হাজার ১২ শত খেলনা বানায়। আজ এই গাওত যদি এই খেলনা বানানোর কাম না থাকলো হিনি হামি কি করে খানোনি।
কারিগর নুর ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ৬০ বছর ধরে সারা দেশের বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে খেলনা বিক্রি এই গ্রামের তৈরি খেলনা পাতি। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর ধরে এই পল্লীতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, এ রকম দুঃসময় গত ৪০ বছরে কখনো দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, করোনা ও লকডাউনের কারণে বিক্রি করতে না পারায় একসময় খেলনা নষ্ট হয়ে যায়। এতে কমপক্ষে এক কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এক যুগ আগেও একটি টমটম বিক্রি হতো ৫-৭ টাকায়। আর এখন একটি টমটম তৈরিতে খরচ হচ্ছে গড়ে সাত টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সারা বছর দেশের কোথাও না কোথাও মেলা চলে। আর এ খেলনার চাহিদা থাকায় একটি টমটম বিক্রি হয় গড়ে ২০ টাকা পর্যন্ত। একজন কারিগর সপ্তাহে ৪শ’ টমটম বানাতে পারে। বৈশাখ মাসে বছরের সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। আর বর্ষার সময় কয়েক মাস বসে থাকতে হয় তাদের।
সংসারের সব কাজ শেষে আবার আয় রোজগার বাড়াতে টমটম তৈরি করেন খোলাশ গ্রামের গৃহবধূ জাহানারা বেগম। স্বামী আকতার মোল্লা একজন টমটম ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তার স্বামী সারা বছর ব্যবসার কাজে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান। চাহিদা বাড়ায় দাম বেশি হওয়ায় পরিবারের ছোট-বড় সবাই টমটম তৈরির কাজে অত্যন্ত দক্ষ।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বগুড়ার উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) এ. কে. এম মাহফুজুর রহমান জানান, খোলাশ গ্রামে এমন হস্তশিল্প রয়েছে তা জানা নেই। তবে তাদের আগ্রহ থাকলে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ বিসিকের সুবিধা নিতে চাইলে তা দেওয়া হবে।
তিনি আরো জানান, এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই আর্থিকভাবে সচল না হওয়ায় তাদের ঋণের বিষয় সম্পর্কে আগে জানাতে হবে। কাজের কর্ম দক্ষতা ও ব্যবসা বাড়াতে বিসিকের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করে তাদের সুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে।
ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর, নরসিংদী, কুমিল্লার হোমনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীর কাঞ্চনপুর ও চট্টগ্রামের লালদীঘিসহ খুলনা আর উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও রংপুরে বড় বড় মেলায় সরবরাহ করা হয় টমটম।
ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা