উদ্যোক্তা ইফাত শারমিন

মাস্টার্স পাশ করলেন বাংলা সাহিত্যে, শিক্ষকতা করতেন গাজীপুরে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরইমাঝে গাজীপুর থেকে ঢাকায় শিফট করলেন পরিবারসহ। ঢাকায় একটি বিদেশী কোম্পানীতে শিফট ম্যানেজার হিসেবে  চাকরী নিলেন ইফাত শারমিন। ৫ বছর কাজ করার পর ভীষণ একঘেয়ে মনে হল জীবন। ভাবলেন বিদেশীদের জন্য আর নয়, নিজের দেশের জন্য কিছু করার। বেতনের কিছু টাকা হাতে ছিলো ইফাত শারমিনের। ক্রিয়েটিভ আইটি নামে একটি ফার্মে অনলাইন মার্কেটিং এর ওপর একটি কোর্স করলেন। ভীষণ শক্তি এলো মনে। নিজের দেশের জন্য, দেশের মানুষকে নিয়ে কিছু করার ইচ্ছেটা  প্রত্যয়ে পরিণত হলো ইফাত শারমিনের কাছে।

ট্রেনিং সেন্টার

কাজ করবেন, কিন্তু কি নিয়ে কাজ করবেন, খাত কোনটি, কাদের নিয়ে কাজ করবেন এই ব্যপারগুলো ভীষণ ভাবিয়ে তুললো তাকে। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রাশিদ চৌধুরী পিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে জানালেন, জামদানী নিয়ে কাজ করলে ভালো সাড়া মিলবে। কারণ জামদানীর আছে অনেক চাহিদা। সচারাচর খুঁজলে অনলাইনে পাওয়া যায় না। পার্শবর্তী দেশের তৈরি জামদানী অস্ট্রেলিয়াতে পাওয়া যায়, ঢাকার বিখ্যাত জামদানী সারা বিশ্বের বাঙ্গালীদের কাছে স্থান করে নিতে পারে এই চিন্তাটাই পুঁজি করলেন ইফাত শারমিন। বিসিক পরিদর্শন করলেন, খুঁজতে থাকলেন উৎস। কোথায় গেলে পাবেন জামদানী শিল্পীদের। তাঁত গুলো কোথায়?

উদ্যোক্তার তৈরি জামদানী শাড়ী

২০১৪ সাল, শাহ আলম নামের একজন কর্মীকে খুঁজে পেলেন তিনি । ৩টি শাড়ী বানালেন তার প্রথম পুঁজি ৫০  হাজার টাকা দিয়ে। নিজের স্বপ্ন জামদানীর ভুবন সাজাতে তৈরি করলেন ‘জামদানী ভিল’ নামে একটি ফেসবুক পেইজ। পেইজে ৩টি শাড়ীর পোস্ট দিলেন। সাড়া মিললো কিছুটা দেরীতে, প্রায় এক মাস ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করলেন অর্ডারের জন্য।

এক মাস পর এলো বহুল প্রতিক্ষীত সেই কল। অনেক কিছু জানতে চাইলেন ক্রেতা, নকল কিনা, শাড়ীর মান যা বলা হচ্ছে দাম অনুযায়ী তা সঠিক কিনা? প্রথম শাড়ীটি বিক্রয় হলো। ক্রেতা ভীষণ সন্তুষ্ট হলেন। নিজের রং পছন্দ করে ডিজাইন করা শাড়ীটি ছিল ল্যাভেন্ডার কালারের। বিক্রয় হলো ৬ হাজার টাকা দিয়ে। লাভ হলো ৫০০ টাকা। ৩টি শাড়ী বিক্রি হবার পর ১৫০০ টাকা মুনাফাই উদ্যোক্তার আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া দিলো।  উদ্যোক্তাও বিশ্বাস করতে লাগলেন পরিশ্রম করে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই।

ক্রেতার কাছে ভিডিও কলে পণ্য প্রদর্শণ

কিন্তু একটা সময় দমে যেতে বসেছিলেন প্রায়। সে সময় ই-ক্যাবের সভাপতি রাজিব আহমেদ তাকে বলেন, অসম্ভব শক্তি নিয়ে টিকে থাকবার জন্য। উদ্যোক্তা অনুপ্রাণিত হলেন এবং এরকম অনেক সুহৃদ শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুপ্রেরণায় এগিয়ে যেতে থাকলেন সামনের দিকে। মান সম্পন্ন পণ্যই আমি দিবো এই সঙ্কল্প থেকে কোনোদিনও  পিছুপা হননি উদ্যোক্তা ইফাত শারমিন।

কোমড় বেধে লাগলেন ২০১৫ সাল থেকে। প্রফিট মার্জিন নির্ণয়, ফেসবুক পেজ এ  সঠিক ভাবে পোস্ট তৈরি,  গুগল প্লাস, টুইটার, পিন্টারেস্ট, লিংকড ইন,  সবগুলোতে এক যোগে জোড় প্রচারণা শুরু করলেন জামদানী শাড়ীর ভুবন সাজিয়ে।

২৪ ঘন্টা নিজের পণ্য নিয়ে কাজ । প্রতিদিন তাঁতিদের তৈরি পণ্য, জামদানীর প্রতি ভালবাসা ফুটে উঠতে থাকল উদ্যোক্তার পেইজ জামদানী ভিলের ভুবন জুড়ে ২০১৫ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত করতে থাকলেন পুরো সময়টা জুড়ে শুধু মাত্র মানসম্পন্ন পণ্য প্রস্তুত এবং ক্যাম্পেইন নিয়ে ।

২০১৬, হুহু করে সেল শুরু হলো। ১০জন, ২০জন এমনকি কাজের অর্ডার অনুযায়ী ৪০ জন তাঁতিদের কে দিয়ে কাজ করাতে শুরু করলেন উদ্যোক্তা ইফাত শারমিন। প্রতি সপ্তাহে, মাসে গড়ে ১ লক্ষ টাকার উপরে বিক্রি হতে থাকল তার অনলাইন স্টোরে জামদানী শাড়ী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বিভিন্ন বিভাগ থেকে, নানা জেলা থেকে, এমনকি চড় অঞ্চল থেকেও জামদানী শাড়ীর অর্ডার আসতে শুরু করল। ঈদ, বিয়ের উৎসব, জন্মদিন কিংবা প্রিয়জন কে গিফট করবার জন্য দুবাই, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়া, ভারত নানা দেশ থেকে অনলাইনে অর্ডার আসতে শুরু করল। উদ্যোক্তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেইজের লাইক বাড়ে সমুদ্রের জোয়ারের মত।

উদ্যোক্তার কর্মব্যস্ত কর্মীবাহিনী

নিজের কর্মী টিমের ৩ জন হেড তাঁতিদের নিয়ে আজ এক্সক্লুসিভ সুতি, এক্সক্লুসিভ হাফসিল্ক, নরমাল হাফসিল্ক এগুলো তৈরি করছেন প্রায় ৩০-৪০ জন কর্মী বাহিনীর অর্ডার মাফিক। আজ উদ্যোক্তা তার জামদানী ভিলে ২৪ ঘণ্টা অফিস করেন, দেশ-বিদেশ সারাক্ষণ।

শ্রদ্ধেয় বাবা রিটায়ার্ড চীফ সাইন্টিফিক অফিসার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, তিনি মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন মেয়ের একাউন্টস তথা হিসাব ডিপার্টমেন্টটি সহায়তা করেন সকল হিসেবের ব্যপারে। মেয়ের উদ্যোগের ব্যপারে উৎসাহ প্রদানে পুরো একাউন্টস সেকশনটি তিনি নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেখেন এবং দেখাশোনা করেন।

উদ্যোক্তা এবং তার বাবা

ঢাকার ভেতর  অনলাইনে যত কুরিয়ার সার্ভিসে সেবা দেন তাদের একটি কোম্পানী এবং ঢাকার বাইরে দুটি কোম্পানী এবং দেশের বাইরে প্রায় তিনটি কোম্পানীর মাধ্যমে সারা দেশে এবং বিদেশে পণ্য দিয়ে থাকেন উদ্যোক্তা। সারাদিন ঘুরেঘুরে কাজ বোঝান। মানসম্মত পণ্য তৈরিতে যারা এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠত ইফাত শারমিনের উপর আজ সেই সকল জামদানী শিল্পীদের শিল্পে এক আদুরে শিল্পী হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা ইফাত শারমিন। আদর করে আজ উদ্যোক্তাকে সবাই ডাকেন জামদানী আপা।

জীবন যুদ্ধে জয় করছেন প্রতিদিন, পাড়ি দিচ্ছেন অনলাইনে একের পর এক সমুদ্র। এক ব্যবসার ভুবন সাজাচ্ছেন দিন রাত। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করে আজ সফল ভাবে পরিচালনা করছেন ৫ লক্ষ টাকা মূল্যমানের ব্যবসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here