জামদানি শাড়ি কেটে জামদানি টাই দিয়ে স্বপ্নপথের যাত্রা

0
উদ্যোক্তা আতিয়া সিদ্দিকা কেয়া

বাবার চাকরির সুবাদে বাবার রাজকন্যা কেয়ার ছোটবেলা কেটেছে ফরিদপুরের কোয়ার্টারে। চিনিকলের কৃষ্ণচূড়া ও জারুল ফোঁটা স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। ফরিদপুর চিনিকল স্কুলেই শুরু হয়েছিল শিক্ষা জীবন৷। ছোট বেলা থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আবৃত্তি, নাচ, সঙ্গীত, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। শৈশব বেশ রঙিন হলেও পরে নানান প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু থেমে থাকেননি। অদম্য মনোবল নিয়ে দু সন্তানকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তার অভিষ্ট লক্ষ্যে।

এসএসসি শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় আসেন কেয়া। অনার্স শেষ করার আগেই বিয়ে নামক শিকলে পা আটকে ফেলেন। হতাশা এসে কড়া নেড়েছিলো, তবে দরজা খুলে তাকে বসতে দেননি কখনো। সংসার-পড়াশোনা-সন্তান সব মিলিয়ে জটিল সময় পার করেছেন। পড়াশোনা শেষ করার পর ক্যারিয়ার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কোথাও জয়েন করা হয়নি শুধুমাত্র সংসার ভেঙে যাওয়ার ভয়ে, সন্তানের মায়ের মমতা আড়াল হওয়ার ভয়ে।

নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এগিয়ে যাবার সুযোগটা না থাকলেও নিজের স্বামীর ক্যারিয়ার গড়ে দেন বাবার অর্থনৈতিক সাপোর্ট আর নিজের দেয়া শ্রম ও শিক্ষার সাথে। একজন সাধারণ ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন নামকরা সফল ব্যবসায়ী, ইমপোর্টার। স্বামীকে প্রতিষ্ঠিত করে কেয়া ভাবলেন, এখানেই তার সফলতা, জীবনের সার্থকতা। কিন্তু একসময় এই সফলতাই কেয়াকে ব্যর্থতায় পরিণত করে। নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস না দেয়াটাই ছিল জীবনের বড় ভুল যা কেয়া প্রতি পদে পদে বুঝতে পারলেন। ১১ বছর পর দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর বুঝতে পারলেন, ভালবাসা দিয়ে যে সংসার টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, তা ভীষণ নড়বড়ে হয়ে গেছে।

দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু হলো কেয়ার বেঁচে থাকার লড়াই। যেভাবেই হোক সন্তানদের মায়ের পরিচয়ে বড় করতেই হবে। শুরু হলো কেয়ার নিজেকে গড়ে তোলার এক অদম্য প্রয়াস। বিশিষ্ট কটিউর পোশাক ডিজাইনার সাব্বির জাহান এর তত্ত্বাবধানে এনআইডি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্স সম্পন্ন করলেন। বিয়েতে বাবার দেয়া জামদানি শাড়ী কেটে জামদানি টাই দিয়েই স্বপ্নপথের যাত্রা শুরু।

তিনি মনে করেন, কারও অনুপ্রেরণা মানে পণ্যের নাম বলে দেয়া নয়, অনুপ্রেরণা মানে কারও হাতে ভর দিয়ে চলা নয়, অনুপ্রেরণা সেটাই যেটা আমায় উদ্ধুদ্ধ করে, আমার আমিকে খুঁজে বের করতে, আমি ঠিক কী পারি সেটাতেই এগিয়ে চলতে হবে, পিছু ফেরা যাবে না, হাজারও বাধার সাথে পাছে লোকে কিছু বলে কথার গঞ্জনা কানে নিয়ে বাছাই করে নিজেকে তৈরী করার মতো আত্নবিশ্বাস নেয়াটাই হলো অনুপ্রেরণার ফলাফল।

২০২০ সালে যখন সংসার জীবনের ইতি ঘটে, তখন তিনি ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি খুঁজে পেলেন। শূণ্যহাতে শুরু করলেন সেই জামদানি টাই, হ্যান্ডপেইন্ট করা শাড়ি, কাঠের বেজ দিয়ে গহনা তৈরি। সামাজিক পাতায় বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের প্লাটফর্মে যুক্ত হয়ে নিজের দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলেছেন প্রতিনিয়ত। ইউএনডিপি ও আনন্দমেলার সহযোগিতায় বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করে ই কমার্সের বিভিন্ন দিকে নিজেকে দক্ষ করে তুলেন। এছাড়াও জয়িতার ফ্যাশন ডিজাইনিং কোর্সটিও সম্পন্ন করেন। একজন সফল উদ্যোক্তা রূপে আত্নপ্রকাশের দুয়ার উন্মোচিত হয় আনন্দমেলা প্লাটফর্মকে ঘিরে।

দেশীয় সংস্কৃতিকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সবসময়। নিজের সৃষ্টিশীল কাজ দিয়ে জামদানি, তাঁত এবং পাটকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি।

পশ্চিমা টাই (গলাবন্ধনী) কে তৈরি করেছেন নবরূপে। আরো রয়েছে গামছা টাই, খাদি টাই, মসলিন টাই, বাটিক টাই, মণিপুরী টাই, তসর টাই কিংবা জামদানির স্যাণ্ডেল, মণিপুরী স্যাণ্ডেল, নাগড়া, পাগড়ি, ওয়ালেট, পার্স, উত্তরীয়, টিস্যুবক্স, জুয়েলারি বক্স, ব্লেজার, শেরওয়ানিসহ আরো নানা কাজ।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ভেজিটেবল ডাইয়ের মতো জটিল বিষয়টি তিনি করেছেন জামদানি ও মণিপুরীতে। এছাড়াও সোনালি আঁশের সোনার বাংলায় পাটের শাড়িকে ভালোবেসে সম্পূর্ণ ভিন্ন পাটের শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন উদ্যোক্তা আতিয়া সিদ্দিকা কেয়া।

নিজস্ব কোনো ফ্যাক্টরি নেই তার, তবে কারখানা মালিকের সাথে কথা বলে পণ্যের ধরণ অনুযায়ী কিছু ফ্যাক্টরিতে নিজের ইনোভেশন করা পণ্যগুলোর আলাদা স্পেস নিয়ে সেটআপ করেছেন। সেক্ষেত্রে কর্মীরা তার হয়ে কাজ করেন। প্রকারভেদে এবং কাস্টোমাইজড করে আনুমানিক দেড় লাখ টাকার উৎপাদন হয়। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে কেয়ার পণ্য। দেশের মধ্যে যাচ্ছে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট, খুলনাসহ ঢাকা বিভাগের কয়েক জেলায়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিবির বসন একটি ব্রান্ড হবে। যেখানে বাংলার ৬৪ জেলার কোন না কোন তাঁত স্থান পাবে। অতীতের বন্ধ হয়ে যাওয়া তাঁত আবারও ফিরে পাবে সম্মান ও জৌলুস বিবির বসনের মিউজিয়ামে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের তাঁত দেখবে আলোর মুখ। যেমন ঠাকুরগাঁও এলাকার হাতে বোনা কম্বল নিয়ে কাজ করেছি এবারের শীতে। দেশের প্রতিটি জেলায় বিবির বসনের আউটলেট হবে। সে সাথে সেখানে কর্মসংস্থান হবে বিধবা, ডিভোর্সি কিংবা অসহায় দুঃস্হ নারীদের। মূল শেকড় হবে একটি মিউজিয়াম কিংবা সংরক্ষণশালার মাধ্যমে যেটি হবে নিজ ভূমি মানিকগঞ্জ। যেহেতু আমার বাবার রাজপ্রাসাদ সেখানে, সেইসাথে বাবা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বাড়ির আঙিনায়। আমি নিজেও সেখানেই শেষ আবাস করে শায়িত হবার আশা রাখি বাবার পাশে। সেইসাথে বিশ্বের বুকে বিবির বসন আলোচিত হবে বাংলার জয় গান সাথে নিয়ে।”

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here