চুইঝালে চমক দেখিয়েছেন মিথিলা

0
উদ্যোক্তা- মিথিলা সাদ তুহিন

ছোটবেলা থেকেই নিজে কিছু করা, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা মনের মধ্যে গেঁথে আছে তুহিনের। ছোটবেলায় স্কুল শিক্ষক মা সবসময় তাকে অনেক বেশি উৎসাহ দিতেন। বাবাও চাইতেন মেয়ে ভালো কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়াক কিন্তু কখনো কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেননি।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার দুর্বাডাঙা ইউনিয়নের পাড়ালা গ্রামের মিথিলা সাদ তুহিন ছোটবেলার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে তুলেছেন; হয়ে উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা।

উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত কেনো নিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে উদ্যোক্তা তুহিন জানান, ‘বিজ্ঞান বিভাগের ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম কিন্তু অসুস্থতার কারণে একাডেমিকভাবে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারিনি। যেখানে আমার ব্যাচের বন্ধুরা মেডিকেল-ভার্সিটিতে ভালো সাবজেক্টে পড়াশোনা করে। আমি ডিপ্লোমাতে মাত্র পড়া শুরু করলাম। কবে পড়া শেষ হবে, কবে আমি জব করতে পারবো, জানি না। তাছাড়া আব্বুর বয়স ষাটোর্ধ্ব তিনিও আগের মতো কাজের চাপ নিতে পারেন না। এছাড়াও হঠাৎ কিছু পারিবারিক সমস্যায় আর্থিকভাবে আমারা অনেক সমস্যায় পড়ে যাই। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে উই গ্রুপের দেখা পাই। মেয়েদের এতো সুন্দর শান্তিপুর্ণ প্লাটফর্ম দেখে ভালো লাগে, একটু একটু করে একটিভ হওয়া শুরু করি। অনলাইন বিজনেসের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানলাম, প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফিসহ টেকনিক্যাল অনেক কিছু জানলাম। উই-এর এই পজিটিভ শক্তি থেকেই আমার পথচলা শুরু।’

ফরিদপুর এগ্রিকালচার ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মিথিলা। ২০১৭ সালে বিউটিশিয়ান হিসেবে ট্রেইনিং নেন। প্রথম কয়েকমাস ঘরে কাজ করার পরে কিছু সমস্যা থাকায় তা ছেড়েও দিতে হয় তাকে। পরবর্তীতে যশোরে স্যামসাং শো-রুমে ইন্টারভিউ দিয়ে সিলেক্ট হন কিন্তু সেখানেও জয়েন করা হয়নি। সে-সুবাদে এখন পর্যন্ত কোথাও চাকরি করা হয়নি। তবে একজন আপুর সাথে যশোরের হাতের কাজ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিলো (ড্রেস ডিজাইন করা, প্রিন্ট করে কর্মীদের দিয়ে নকশা তোলা, ব্লকপ্রিন্ট)।

গেলো বছর ‘যশোরকন্যা’ নামে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন উদ্যোক্তা তুহিন। কী কী পণ্য নিয়ে কাজ করছেন? জানতে চাইলে উদ্যোক্তা জানান, ‘হাতের কাজ আগে থেকেই জানতাম তাই শুরুতে যশোরের হ্যান্ডস্টিচ ও হ্যান্ডপেইন্টের কাজ শুরু করি। ততোদিনে উই গ্রুপের পরিচিতির সূত্রেই যশোরের বিখ্যাত খেজুর গুড়ের চাহিদা বুঝতে পেরে খেজুরগুড় নিয়ে কাজ শুরু করি। মাত্র ৫০ কেজি গুড়ের টার্গেট নিয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত ৩ মাসে প্রায় ২০০ কেজির বেশি গুড় সেল করি। বর্তমানে আমি যশোর-খুলনার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী পণ্য ‘চুইঝাল’ নিয়ে কাজ করছি’।

মায়ের দেওয়া দুই হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করে এখন মাসেই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করছেন তুহিন। তার কোনো নিজস্ব শো-রুম বা অফিস আছে কী না জানতে চাইলে তিনি জানান, “গত ডিসেম্বরে উই-এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা আপুর একটি পোস্ট থেকে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কতৃক আয়োজিত ‘স্টার্টআপ কম্পিটিশন, যশোর চ্যাপ্টা’-এর কথা জানতে পারি। উই’র বিভিন্ন পোস্ট-লাইভ থেকে ‘স্টার্টআপ’ শব্দটার সাথে পরিচিত ছিলাম কিন্তু বিস্তারিত সম্পর্কে অনেক কিছু ধারনা ছিলো না। ডিএসবি গ্রুপে স্টার্ট-আপ নিয়ে পড়াশোনা করি, ইন্টারনেট, গুগল ও ইউটিউব থেকেও অনেক কিছু পড়ি, জানার চেষ্টা করি। তারপর আমাদের প্রোজেক্ট রেডি করে সাবমিট করি।

‘যশোরকন্যা’ টিম অংশগ্রহণ করে, টিম লিডার হিসেবে আমি আইডিয়া প্রেজেন্ট করি। প্রথমে ওয়েটিং-এ ছিলাম এবং পরবর্তীতে সিলেক্ট হই। যার ফলে যশোর আইটি পার্কে আমরা অফিস বরাদ্দ পেয়েছি। আমাদের স্টার্ট-আপ-এর শুরু থেকেই আমার সাথে কাজ করছেন আমার বন্ধুপ্রিয় বোন সোনিয়া আফরিন এবং আমার ছোটভাই আরাফাত ইনজামাম। এছাড়া আমার বাবা-মা সবসময়ই সাহায্য করেছেন”।

তুহিনের যশোরকন্যা’র হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বর্তমানে ১০০ জনের মতো কর্মী কাজ করছেন। মোটামুটি সারাদেশেই এখন পৌঁছে যাচ্ছে তার পণ্য।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্যোক্তা বলেন, “কঠিন হলেও এটাই সত্যি যে, বর্তমান সমাজে সম্মান নিয়ে চলার জন্য একটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজের পরিচয় তৈরী করা খুব জরুরী। মেয়েদের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে পরিবারের পাশে থাকা যায়, মা-বাবার পাশে থাকা যায়। যশোরের শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি একটা টান তো আছেই, এছাড়া জন্মসুত্রে ছোটবেলা থাকেই দাদীর হাতে সেলাই দেখে শখের বসে শিখেছিলাম, অনেকের কাছে যশোরের শিল্পের সুনাম শুনতাম সাথে আফসোস ও শুনতাম, ‘আগের মতো হাতের কাজ আর পাওয়া যায় না, গুড়ের সেই স্বাদ আর এখন নাই’। যশোরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চাই, শিল্পকে ধরে রাখতে চাই, আগের দিনের সেই নকশীকাঁথার রূপ, বিখ্যাত খেজুরের গুড়, বিখ্যাত চুইঝালের স্বাদ পৌঁছে চাই সকলের কাছে।”

সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here