উদ্যোক্তা সুমিত শাহ

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেবের মেজাজ তিরিক্ষি। তাকে একটু শান্ত করতে নিজের চায়ের কাপে চুমু খাওয়া দরকার। এই টোটকা টের পেয়েছিলেন কলকাতার চা ব্যবসায়ী ৩২ বছরের যুবক সুমিত শাহ। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সারা বছর ফেলে-ছড়িয়ে পান করেও চা শেষ করতে পারবেন না এমন পরিমাণ চায়ের বাক্স প্লেনে করে ট্রাম্প টাওয়ারে পাঠিয়েও দিয়েছিলেন লন্ডন বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করা মধু জয়ন্তী চা সংস্থার অন্যতম কর্ণধার সুমিত।

শীতের এক দুপুরে তার সঙ্গে কথা হয় বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে তার অফিসে। বলছিলেন, চায়ের ব্যবসাটা নতুন নয়। বাবা, দাদু সবাই এই ব্যবসা করেছেন। ১৯৪২ সালে শুরু করেছিলেন ঠাকুরদাদা জয়ন্তীলাল শাহ। ঠাকুমা মধু শাহের নাম এবং নিজের নাম জড়িয়ে সংস্থার নাম দিয়েছিলেন মধু জয়ন্তী।

৭৫ বছরের পুরানো এই সংস্থায় তিনি নিয়ে এসেছেন স্টার্টআপ চালানোর স্পিরিট। বিদেশে পড়াশোনা করার সময় নিজে একটি স্টার্টআপ সংস্থা চালানোর চেষ্টা করেন। তথ্য প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট মারফত স্কুল শিক্ষাকে আরো মনোগ্রাহী করে তোলার একটা প্রয়াস। শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধানের অবিকল মসৃণ একটি রাস্তা আবিষ্কার করেন উদ্যোক্তা সুমিত। নিজের আইডিয়ার পিছনে অনেক শ্রম দিয়েছেন। অনেক লড়েছেন। যাকে বলে বুটস্ট্র্যাপ।

কিন্তু সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা উদ্যোক্তা সুমিতের সেই স্টার্টআপটা সাফল্য পায়নি। ২০০৫-০৬ সাল নাগাদ তিনি ভেবেছিলেন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লব আনবেন। কিন্তু ওপর থেকে সমাধানের যে রাস্তা বেরিয়েছিল, বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে শিক্ষার মানকে তুলে আনার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তখন তা প্রয়োগ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। রাজনীতি, সমাজ, দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো সব কিছুই এক সঙ্গে সুমিতের ওই স্টার্টআপ নিয়ে এগোবার পথ আগলে দাঁড়িয়ে ছিল। জীবনের মোক্ষম শিক্ষাগুলো অবশ্য ওই স্টার্টআপ চালানোর সময়ই পেয়ে গিয়েছিলেন বছর একুশের ছেলেটা। বুঝেছিলেন প্যাশন ছাড়া কোনো উদ্যোগই সফল হওয়ার নয়।

ধীরে কিন্তু স্থিরভাবে টের পেলেন বাবা-দাদার পুরানো ব্যবসাই তার আসল প্যাশন। চা এবং চায়ের ব্যবসা নিয়ে তাই মগ্ন হয়ে থাকতে ভালোবাসেন সুমিত শাহ।

নতুন করে গড়ে তুলছেন ব্র্যান্ড। ‘টি আ মি’ (TE -A -ME)। গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে তাদের চায়ের সুখ্যাতি। এক সময় চা বাগান ছিল। ১৯৮০’র দশকে বন্ধ হয়ে যায়। তাই বলে চায়ের ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নেননি তার বাবা। বরং নিজেদের আরও বেশি বেশি করে বিপণনের কাজে নিযুক্ত রেখেছিলেন।

পরিবারের একমাত্র ছেলে সুমিত। বড় হয়েছেন কলকাতায়। লামার্টিনিয়ার স্কুলে পড়াশুনো করেছেন। তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যান ক্যালিফোর্নিয়া। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে এমবিএ করতে যান লন্ডন। লন্ডন বিজনেস স্কুলে এমবিএ করে ফিরে আসেন ২০০৯-১০ সাল নাগাদ।

সুমিতের ফিরে আসা মানে শুধু কলকাতায় ফিরে আসা ছিল না, বাবা-দাদার ব্যবসার হাল ধরাও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। ‘মধু জয়ন্তী’ (Madhu Jayanti International Limited) ১৯৮০ নাগাদ ভারত থেকে প্ৰথম চা রফতানিকারক সংস্থার মর্যাদা পায়। তারপর ১৯৮৫ সালে তাদের ব্র্যান্ড ‘জয় টি’ (JAY TEA) ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে বিশ্বের কোণায় কোণায়। সেই ধারাই অব্যাহত রেখেছেন সুমিত। ২০০৯ সাল থেকেই শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রদর্শনীতে নিজেদের ব্র্যান্ডকে প্রোমোট করা। প্রাইভেট লেবেল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনগুলোয় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন সুমিত। জার্মানির কোলোনে আনুগা’র ফুড ফেয়ারে, আমস্টরডমে পিএলএমএ’র একজিবিশনে নিজেদের ব্র্যান্ডকে এমনভাবে নিয়ে যান যাতে দ্রুত আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার অবস্থান জোগাড় করতে পারে তার সংস্থা।

পাশাপাশি শুরু হয় চা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাও। ২০১৪ সালে ১৪৬ বছরের পুরানো বামার লরি’র মতো সংস্থাকে অধিগ্রহণ করে নেয় মধু জয়ন্তী ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থার প্রোডাক্ট লাইনেও সংযোজিত হতে থাকে বিভিন্ন ধরণের চা। দেশি-বিদেশি চা তো আছেই, পাশাপাশি ভারতেরও নানা ধরণের চাকে ব্র্যান্ডিং করতে থাকেন উদ্যোক্তা সুমিত।

এখন মনোনিবেশ করছেন আয়ুর্বেদিক চায়ে। বিভিন্ন ধরণের গাছ গাছালি থেকে চা এবং নানান মশলা দিয়ে তৈরি চায়ের এক বিপুল সম্ভার তৈরি করে ফেলেছেন তারা। ভবিষ্যতে এই আয়ুর্বেদিক চা দিয়েই আরও বড় বাজারে থাবা বসাতে চাইছেন উদ্যোক্তা সুমিত। পাশাপাশি মার্কিন বাজারে আর্জেন্টিনার চায়ের দারুণ কাটতি দেখে এসেছেন। তাই সেই বাজারেও হাজির সুমিতের ‘টি আ মি’।

‘টি আ মি’ বিশ্ব বাজারে যে চা বাজারজাত করে থাকে তার মধ্যে আছে, প্রাকৃতিক সবুজ চা পরিসীমায় পাঁচটি রূপ রয়েছে – গ্রিন টি, মধু লেবু সবুজ চা, পুদিনা গ্রিন টি, কাশ্মীরি কাহওয়া এবং জুঁই গ্রিন টি।

তিনটি সুগন্ধযুক্ত মশলা চা রয়েছে- মাসালা চা, এলাচ চা, এবং আদা চা।তিনটি ফল এবং ফুলের ইনফিউশন- ক্যামোমাইল, আপেল দারুচিনি এবং ক্র্যানবেরি আপেল।

এছাড়া আরো পাঁচটি চা রয়েছে- আসাম চা, দার্জিলিং চা , ইংলিশ প্রাতঃরাশের চা, আর্ল গ্রে টি, লেবু চা এবং তুলসী গ্রিন টি।

এখন লক্ষ্য একটাই এগিয়ে চলা। নিজেদের চায়ের বিস্ট্রো চেইন তৈরি করতে চান সুমিত। যেখানে পাওয়া যাবে পৃথিবীর সব রকম চা। ধুয়ো ওঠা কিংবা হিম শীতল। কিন্তু অভ্যর্থনায় কখনও সেখানে উষ্ণতার অভাব হবে না।

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here