মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তা- আমান উল্লাহ

মা আমাকে একটা খেলনা কিনে দাওনা প্লিজ।

খেলনা শিল্প। একসময় দেশে খেলনা আসতো চীন থেকে। আজ সেই খেলনার ৬০ শতাংশ মিলছে দেশীয় উৎপাদন থেকে।

২০১০ এর আগে মাত্র ২৫ জন উৎপাদক ছিলো। বর্তমানে তা ১০০ জন ছাড়িয়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তারা প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার খেলনা সামগ্রী উৎপাদন করেন।

২০১০-২০১৮ অর্থবছরে খেলনা আমদানী ৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা।

উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরিতে তৈরি খেলনা

আমি ই একটা বাংলাদেশ। আলোচনা শুরুর প্রথম কথাটা বললেন তরুণ আমান-উল্লাহ। ২০০৩ সালে সাড়ে বার বছর বয়সে ঢাকা আসেন। বাবা বিদেশ গিয়েছেন। কোনো কাজ পাননি। এমনই অবস্থায় ৬ ভাই-বোনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে ঢাকায় আসেন খেলনার এই জাদুকর। একটি খেলনা বানানোর কারখানায় কাজ নিলেন। বাচ্চাদের ঝুনঝুনি বানাতেন আমান। ঝুনঝুনির শব্দ স্বপ্ন এঁকে দেয় কিশোর আমান এর চোখে। জীবন যুদ্ধে জয় করতে হবে।

খেলনা বানানোর কাজ করছেন নারী কর্মীরা

৫ বছর কাজ করবার পর বাবা আমান উল্লাহকে বললেন বিদেশ চলে আসতে। কিশোর আমান তখন তরুণ। তরুণ আমান তখন ভাবলেন, না আমি বিদেশ যাব না। ৫ বছর আমি যে কাজ করেছি, তা আমি আমার দেশকে দেব।

দেশে তখন এন্টি প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি হতো। বল, বাচ্চাদের খেলনা বন্দুক আর কয়েকটি গাড়ি। বিদেশের অনেক খেলনায় তখন বাংলাদেশে চলতো। বাবাকে সরাসরি না বলে দিলেন তরুণ আমান। আমান মায়ের সাথে পরামর্শ করলেন। মা’র গহনা ও সঞ্চিত অর্থ সব মিলিয়ে ৯০ হাজার টাকা দিয়ে জাদুকর খেলনাওয়ালা দিলেন তার ফ্যাক্টরি। পুরান ঢাকায় ১/১ ছোট কাটরাতে ১১/১৫ ফিটে ফ্যাক্টরি দিলেন তরুণ আমান।

ফ্যাক্টরিতে কর্মরত কর্মীগণ

২০০৮ সালে মাত্র একটি মোল্ড দিয়ে অন্যজনের মেশিনে খেলনা প্রস্তুত শুরু করলেন। শুরু করলেন নতুন এক জীবন তরুণ আমান। প্রথম খেলনাটি তৈরি করলেন সেটি হলো বাচ্চাদের ঝুনঝুনি। আবারও স্বপ্ন দেখায় ঝুনঝুনি।

এরপরেরটুকু ইতিহাস…

ইতিহাস গড়তে প্রয়োজন হয় নায়কের। আমান হলেন সফলতার সেই ইতিহাসে যুদ্ধের রাজা। এক ঝুনঝুনিতেই বাজিমাত। সারা বাংলাদেশে ঝুনঝুনি এনে দিলো তরুণ আমানকে দূরন্ত সাফল্য। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন আমান।

খেলনার বিভিন্ন অংশের কাজ করছেন কর্মীরা

মা কে সোনার চেইন কিনে দিলেন ছেলে। প্রথম ব্যবসায় লাভ করে মায়ের কাছে অনেক দোয়া পেলেন তরুণ আমান। পেলেন হাসিমুখ, নির্ভরতা, অনুপ্রেরণা। কোমড় বেঁধে নিজের ফ্যাক্টরিতে ১৭-১৮ ঘন্টা কাজ করেন প্রতিদিন। কোনো কোনো সময় ২০ ঘন্টা।

বিদেশী যে খেলনাগুলো আসে বাংলাদেশে তার সব খেলনা দেশেই বানানো সম্ভব। আমি বানাবো, প্রত্যয় এবং স্বপ্নে বলিয়ান আমান। খেলনা হেলিকপ্টার, স্পোর্টস কার, খেলনা নানান হাড়ি, বাটি, কড়াই, ড্রাগন, এরোপ্লেন, খেলনা বন্দুক, খেলনা বাস, পুলিশের গাড়ি সব কিছুই বাংলাদেশে বানানো সম্বভ। যদি বিদেশে বানানো যায়, তাহলে দেশেও বানানো যাবে।

ফ্যাক্টরিতে তৈরি বিভিন্ন ধরণের খেলনা

দৃঢ় প্রত্যয় নিলেন আমান। বিদেশ থেকে আসা খেলনাগুলো নিয়ে গবেষণা করেই বুঝলেন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। প্রথম অবস্থায় বিদেশ থেকে শুধু মোল্ড বানিয়ে আনলেন। ইলেক্ট্রনিক এবং ফিক্সেশন করে খেলনা তৈরি করা সম্ভব। যার কিছুটা পার্টস আসবে বিদেশ থেকে। এবং  ২৫-৩০ শতাংশ বেশি উন্নত খেলনা বানানো সম্ভব হবে বাচ্চাদের জন্য অন্যান্য দেশের তুলনায়। দেশের টাকা দেশেই থাকবে, কর্ম-সংস্থান সৃষ্টি হবে। গার্মেন্টসের মত আমাদের দেশের প্লাস্টিক খেলনা শিল্প হতে পারে এক উজ্জ্বল খাত। বিশ্বাসে এগিয়ে যাওয়া দেশীয় পণ্যে।

২০০৯ সালে মাত্র ৪ বছরে নিজস্ব সক্ষমতায় নিজস্ব মেশিনে প্রথম ফ্যাক্টরি দিলেন কামরাঙ্গীর চড়ে। ১৪ হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্যাক্টরি রূপ পেলো। প্রথম যেদিন ফ্যাক্টরি দিয়েছিলেন আমান তখন দুই জন কর্মী ছিলো সাথে। আজ ৩০০ জন কর্মী নিয়মিত এবং চুক্তিভিত্তিক কাজে কর্মরত প্রায় ৫০০ জনের উপরে।

খেলনা তৈরির একেক ধাপের কাজ সম্পন্ন করছেন কারিগর

নারী-পুরুষের কর্মের সমতা বিশ্বাস করেন তরুণ উদ্যোক্তা আমান-উল্লাহ। ৭ শতাংশ মহিলা কর্মী আজ ফ্যাক্টরিতে কর্মরত আছেন। একটি শিফট এ চলছে খেলনা তৈরির কাজ। বর্তমানে বাচ্চাদের জাদুকর খেলনাওয়ালা এসএমই উদ্যোক্তা আমান-উল্লাহ, বাংলাদেশের শিশুদের জন্য তৈরি করছেন, কার, মোটরসাইকেল, গিটার, প্লেন, হেলিকপ্টার, এক্সক্যাভেটর, কন্সট্রাকশন সেট, লেগো, হোয়াইট বোর্ড এমন সব স্বপ্নীক খেলনা যা বাচ্চারা অনেক পছন্দ করে।

অটিস্টিক শিশুদের স্কুলে বিনামূল্যে দেবার জন্য আমান তৈরি করছেন রোবট খেলনা এবং হোয়াইট বোর্ডের খেলনাটি।

খেলনা তৈরির কাজ করছেন উদ্যোক্তার কর্মীগণ

১১/১৫ ফিটের ফ্যাক্টরিতে যাত্রা শুরু করে বিদেশকে না বলে কঠোর পরিশ্রম দিয়ে দেশের জন্য কিছু করবার প্রত্যয় নিয়ে মায়ের প্রথম ৯০ হাজার টাকাকে করেছেন ৩ লক্ষ টাকা। ১১/১৫ ফিটকে করেছেন ১৪ হাজার স্কয়ার ফিট এবং ২১ হাজার স্কয়ার ফিটে মোট ৩৫ হাজার স্কয়ার ফিট। এবং ৪ জন কর্মীকে বানিয়েছেন ৪০০ জন।

জীবন যুদ্ধে জয় করে আজ হয়েছেন মাঝারী খাতের স্বনামখ্যাত সফল এসএমই উদ্যোক্তা।

 

অপু মাহফুজ

1 COMMENT

Leave a Reply to খালিদ মিরাজ Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here