উদ্যোক্তা- জেরিন হান্নান

একটা মাছ যে একটা জাতির জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ইলিশ আর বাঙালিকে না দেখলে বোঝা যেত না। ইংরেজিতে ‘অবসেস্ড’ বললে ঠিক, আর বাংলায় ‘ ইলিশ–পাগলামি ‘ বলা যায়। বর্ষা এল অথচ পাতে এক টুকরো ইলিশ পড়ল না, দুটো গরম ভাত ইলিশের তেল মেখে খাওয়া গেল না, মুচমুচে ভাজা ইলিশ মাছের ডিম চাখা গেল না- জীবন যেন গন্ধহীন-বর্ণহীন হয়ে পড়ল। বঙ্গ জীবনের অঙ্গ ইলিশ নিয়ে তাইতো যুগে যুগে বহু কাব্য গাঁথা হয়েছে

আজকে উদ্যোক্তা বার্তায় এমন একজন উদ্যোক্তা কে নিয়ে কথা বলবো যিনি কল্পে গল্পে ইলিশ আপু।

ইলিশ আপু (জেরিন হান্নান) ব্যবসায় প্রশাসনে লেখাপড়া শেষ করেন। সব সময় মনের মধ্যে ইচ্ছে ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগিয়ে একদিন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবেন। সেক্ষেত্রে সংসার-জীবন, চাকরি, পড়ালেখা সবকিছু সামলে সেভাবে ব্যবসার জন্য সময় বের করা সম্ভব উঠতো না।

সময়ের পথ পরিক্রমায় ইলিশ আপু হাজবেন্ডের চাকরিসূত্রে সপরিবারে চাঁদপুর চলে আসেন ২০১৮ সালে। ইলিশ আপু বলেন, “চাঁদপুরের ইলিশ কিংবা পদ্মার ইলিশের কথা সারাজীবন শুনে এসেছি, ইলিশ খেয়েছি কিন্তু চাঁদপুরে এসেই চর্মচক্ষে এই ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করলাম! বিশাল পদ্মা-মেঘনায় হাজার হাজার জেলে লক্ষ লক্ষ টন ইলিশ আহরণ করছে। রাতভর মাছ ধরে সেগুলো মাছঘাটে নিয়ে আসছে, আড়তগুলোতে নিলাম হচ্ছে, অসংখ্য ট্রাকে চেপে সেই মাছ সারাদেশে বিভিন্ন বাজারে চলে যাচ্ছে- এ যেন এক মহাযজ্ঞ! পুরো ব্যাপারটি প্রত্যক্ষ করে আমি ভীষণ রোমাঞ্চিত অনুভব করি ! যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না”।

উদ্যোক্তা ইলিশ আপুর মনে চাঁদপুর ইলিশ ঘাট থেকেই ধীরে ধীরে মাছ নিয়ে কাজ করার একটি আগ্রহ তৈরি হয়। বেশ কিছুদিন যাবার পর উদ্যোক্তা ইলিশ আপু বুঝতে পারেন- “অনেক সেক্টরেই নারী উদ্যোক্তারা বেশ সফলতার সাথে কাজ করলেও কেন যেন মাছ নিয়ে, বিশেষ করে ইলিশ মাছ নিয়ে কোন নারী উদ্যোক্তা কে সেভাবে কাজ করতে দেখেননি। কারণটা সম্ভবত অত্যধিক পচনশীল এবং ঝামেলাপূর্ণ ডেলিভারি সিস্টেম এর কারণে। উদ্যোক্তা ইলিশ আপু এই চ্যালেঞ্জটা কে একটি অপরচুনিটি গ্রহণ করেন, যেহেতু কোনো নারী উদ্যোক্তা এই সেক্টরে ইলিশ মাছ নিয়ে নেই, তাই ভ্যাকুয়ামটা পূরণ করার জন্য এই সেক্টরে উদ্যোক্তা ইলিশ আপু এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

এভাবেই উদ্যোক্তা ১ লা জুন “মাছের হাট বাজার” নামে ফেইসবুক এ পেজ খুলে অনলাইন শপের যাত্রা শুরু করেন, সেই ধারাবাহিকতায় উদ্যোক্তা চাঁদপুর মাছ ঘাটে বেশকিছু জেলেদের সাথে চুক্তি, আড়তদারদের সাথে মাছ ক্রয়-বিক্রয়, কর্মচারী নিয়োগ, নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ডেলিভারি ম্যান এবং ট্রান্সপোর্ট এর ব্যবস্থা করেন।

উদ্যোক্তা আরো বলেন, অনলাইন অর্ডার কিংবা হোম ডেলিভারি আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয় ছিল তবে করণা মহামারীর সময় লোকজন আরো বেশি হোম ডেলিভারি এবং অনলাইন অর্ডার এর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আমি আমার ফেসবুক পেইজকে হাজারো গ্রাহকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে নিজে গর্ববোধ করছি।

“মাছের হাট বাজার” নদীর টাটকা তাজা মাছ দিনে দিনে চাঁদপুর থেকে বাংলাদেশের সকল জেলা শহরে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে গ্রাহকের কাছে সময় মতো ডেলিভারি করছে। যা অসংখ্য গ্রাহকের কাছে “মাছের হাট বাজার” আজকে সুনাম, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসের প্রতীক। এই প্রসঙ্গে উদ্যোক্তা ইলিশ আপু বলেন “এক্ষেত্রে তার চেয়েও বড় অবাক করা ব্যাপার ছিল আস্ত মাছ হোম ডেলিভারি হচ্ছে dhaka-chittagong-sylhet এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে! এরকম বেশ কিছু নতুনত্ব এবং অভাবনীয় ব্যাপার যেগুলো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল সেগুলো আমি এবং আমার “মাছের হাট বাজার” এর নিবেদিত প্রাণ কর্মী বাহিনী ম্যানেজ করেছি অত্যন্ত সফলতার সাথে এবং পেশাদারিত্বের সাথে”।

উদ্যোক্তার “মাছের হাট বাজার” পেজটি বা প্রতিষ্ঠানটি অন্যদের চেয়ে একটি জায়গায় একেবারেই ভিন্ন। ফেসবুকে মাছ নিয়ে আরও বেশ ক’টি পেইজ কাজ করে, কিন্তু “মাছের হাট বাজার” পেজটি শুধুমাত্র চাঁদপুরের ইলিশ এবং নদীর মাছ নিয়ে কাজ করে। উদ্যোক্তা তার পেশাদারিত্ব মনোভাব নিয়ে বলেন- “তাঁর ব্যবসার বেশকিছু গ্রাহকের কমপ্লেন থাকার কারণে ফিফটি পার্সেন্ট থেকে শুরু করে পুরো অর্ডারের মাছ বিনামূল্যে রিপ্লেস করেছি, অনেক সময় এডভান্স এর টাকা রিটার্ন করেছি। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের কোন ট্রেডিশনাল কাঁচাবাজারের মাছ ব্যবসায়ী কোনদিন এই লেভেলের সার্ভিস গ্রাহককে দিবেন”।

গল্প ফুরোয়। ফুরোয় না ইলিশের গল্প। একবার শুরু হলে, তার শেষ নেই। ইলিশের মাথা থেকে ল্যাজা কিছুই যায় না ফেলা। ইলিশের গল্পের মহিমা এমনই। যেখানেই কামড়, সেখানেই চমক। আর সবচেয়ে বড় চমক, বাঙালির পাত থেকে তার নিরুদ্দেশ যাত্রায়। আমরা কত কিছুর জন্যই তো প্রার্থনা করি। বৃষ্টির জন্য, নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য। আসুন, সমবেত হয়ে ডাকি সেই রাহমানুর রাহিমকে বলি – ” আয়, ইলিশ ঝেঁপে, বরষা দেব মেপে….”।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here