টেকনিক্যাল ক্যারিয়ার ছেড়ে স্কিন কেয়ার শিল্পে আসতে সাবরিনা ট্যানকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো নারী হিসেবে কাজ করা। কর্মস্থলে একজন নারী হিসেবে তার এই শক্তিশালী অবস্থান সাবরিনার নিজের কাছেই নতুন ছিলো।
কেননা তিনি সিঙ্গাপুরে তাঁর নিজ পরিবারে তিন ভাইয়ের সঙ্গে বড় হয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে আইবিএম, ওরাকল এবং হিউলেট-প্যাকার্ডের মতো পুরুষ-কর্তৃত্ব সংস্থাগুলোয় কাজ করেছেন।
কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে বিউটি শিল্পের দিকে চলে যাওয়াটা উদ্যোক্তা সাবরিনার জীবনে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন ছিলো। স্কিন ইঙ্ক চালু করার মধ্য দিয়ে মাত্র এক দশক আগে তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
স্কিন ইঙ্ক হলো একটি সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক ব্র্যান্ড। উদ্যোক্তা সাবরিনা ট্যান বিশ্বখ্যাত প্রসাধনী ব্র্যান্ড স্কিন ইঙ্ক ডটের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী। বর্তমানে তারা তাদের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছেন। প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটি এক কোটি ডলার রাজস্ব দিয়ে থাকে। সেখান থেকেই ধারণা করা যায় যে তাদের মোট বিক্রির পরিমাণ কতোটা বিশাল।
উদ্যোক্তা সাবরিনা আদর্শ ব্যক্তিবর্গের থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়ে থাকেন। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস্-কে দেখে তিনিও নিজের একটি স্বতন্ত্র বিউটি কোম্পানি চালু করার স্বপ্ন দেখেন। ‘আমি স্কিন কেয়ারে অ্যাপল’র মতো ব্র্যান্ড তৈরি করতে চেয়েছিলাম’- বলেন সাবরিনা।
সিঙ্গাপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা ও অর্থনীতিতে পড়াশোনা করার পর সাবরিনা তার প্রথম চাকরিটি একটি কারিগরি প্রতিষ্ঠানে নেন। সেখানে তিনি ব্যবসায়ের উন্নয়ন বিভাগে দায়িত্ব পালন করতেন। বছরের পর বছর সেখানে কাজ করার সময় তাকে ঘন ঘন পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে হয়েছে। এই অতিরিক্ত ভ্রমণের চাপে তার ত্বকে এক ধরণের একজিমা সংক্রমণ দেখা দেয়। একজিমা হলো এক ধরণের চামড়ার অ্যালার্জি এবং সাবরিনার ত্বক এই অ্যালার্জি সংবেদনশীল ছিলো। ডাই বা রঙের মতো পদার্থ, সেই সঙ্গে আবহাওয়া পরিবর্তন সাবরিনার ত্বকে বেশ প্রভাব ফেলতো।
সব মিলিয়ে উদ্যোক্তা সাবরিনা বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজছিলেন। এক সময় যখন তার দুই শিশুও একজিমায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন তখন তিনি বাধ্য হয়ে দ্রুত একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তখন উদ্যোক্তার মনে হয়েছে, স্কিনকেয়ার রুটিনকে আরো উন্নত করা প্রয়োজন। সেই থেকে পুরো বিষয়টি উদ্যোক্তা নিজের হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর ২০০৭ সালে উদ্যোক্তা জাপানে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বা কারণ অনুসন্ধানের অভিযান শুরু করেন। সাবরিনা মূলত বিশ্বের অন্যতম বড় একটি প্রসাধনী প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলেন এটা জানতে যে কেন তার ক্ষেত্রে কোনো পণ্য কাজ করেনি। এ প্রসঙ্গে সাবরিনা বলেন, ‘আমি রসায়নবিদ এবং বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। ড্রাগ-স্টোর থেকে শুরু করে মার্কেটের বিউটি কর্ণার কোনোটাতে যাওয়াই বাদ রাখিনি’।
সাবরিনা এক সময় জাপান সফর করেন এবং সেখানে আবিষ্কার করেন যে জাপানিরা কিছু বিশেষ উপাদান ব্যবহারের ব্যাপারে উৎসাহী। সফরে উদ্যোক্তা সাবরিনা একটি ল্যাব বা পরীক্ষাগার খুঁজে পান যা তার চাহিদার কথা বুঝতে পেরেছিলো। সাবরিনা চেয়েছিলেন ত্বকের যত্নে এমন একটি প্রসাধনী তৈরি করতে যা সবার ব্যক্তিগত পর্যায়ের সকল সমস্যার সমাধান করবে। জাপানের এই সফরটি তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে বড় ধরণের আত্মবিশ্বাস দিয়েছিলো।
জাপান সফর শেষে সাবরিনা তার স্বামীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। স্বামীর কাছে আইডিয়াটি বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়। তারা দু’জনই ব্যবসার প্রতি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন এবং চাকরি ছেড়ে এই ব্যবসায় মনোযোগ দেন। সারা জীবনের জমা পুঁজি বিনিয়োগ করেন এই ব্যবসায়। সাবরিনা চেয়েছেন তার পুরোটুকু ব্যবসায় দিতে। অনেক সময় সাবরিনা ড্রাইভওয়েতে গাড়ির মধ্যে বসে ভাবতেন ‘আমি কি সঠিক কাজ করেছি?’ মনের ভেতর বিপর্যয়ের শঙ্কা প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করতো।
এভাবে বছর গড়াতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সাবরিনার এই ব্র্যান্ড প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানটি ত্বকে ব্যবহারের সিরাম, ক্রিম এবং হাই-টেক সৌন্দর্য সামগ্রী বিক্রি করে থাকে। এখন তারা সিঙ্গাপুরে আরো দুটি দোকান খুলছে।
উদ্যোক্তা সাবরিনার ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয় সৌন্দর্যের বৈশ্বিক পাওয়ার হাউস ‘সেফোরা’র সঙ্গে একটি বিতরণ চুক্তি। ফরাসি এই প্রতিষ্ঠান তাদের বিশাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে সাবরিনার কোম্পানির বড় ধরনের প্রচারণা করে। ফলে গ্রাহকদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সাবরিনার পণ্যের নাম। সেফোরা মূলত কাস্টমাইজড স্কিন কেয়ার পণ্যের প্রতি আগ্রহী ছিলো। এ জন্য তাদের একজন নির্বাহী সিঙ্গাপুরে স্কিন ইঙ্ক স্টোর পরিদর্শন করেন। এভাবে সেফোরায় জায়গা হয় স্কিন ইঙ্কের। বর্তমানে স্কিন ইঙ্ক এশিয়ান স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে এখন শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
সিঙ্গাপুরের এই ব্র্যান্ডটি তাদের সমস্ত পণ্য তৈরি করে জাপানে, যা বিশ্বব্যাপী তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের চেইন নর্ডস্ট্রোমের মতো খুচরা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানও স্কিন ইঙ্কের প্রসারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরবর্তীতে নিউইয়র্কের বার্গডোর্ফ, গুডম্যান এবং ব্রিটেনের সেলফ্রিজেসের মতো বিলাসবহুল দোকানে ছড়িয়ে পড়ে স্কিন ইঙ্ক। স্কিন ইঙ্কের কিছু সেবা বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যস্ত নারীদের জন্য সৌন্দর্য চিকিৎসা।
উদ্যোক্তা সাবরিনা বলেন, ‘চীনে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, পৃথিবীতে কোনো কুশ্রী নারী নেই, শুধু অলস নারী আছে’। সেই অলস নারীদের ত্বকের যত্নের দায়িত্বটিই নিতে চেয়েছে স্কিন ইঙ্ক।
এই ব্র্যান্ডের মূল বিষয়টি হলো প্রযুক্তি। যেটা সাবরিনার চিন্তা-ভাবনাকে পরিচালনা করার পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্যের বিকাশে সহায়তা করে। অনলাইনে জরিপের মাধ্যমে এবং লাখো গ্রাহকের ত্বক পরীক্ষা করে তথ্য সংগ্রহ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য সিঙ্গাপুর, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বহু কর্মী কাজ করছে। স্কিন ইঙ্ক সেই তথ্যের ভাণ্ডার ব্যবহার করেই পণ্য প্রস্তুত করে থাকেন। স্কিন ইঙ্ক জানার চেষ্টা করেন যে, কতজন নারী পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারেন না বা ব্যায়াম করেন না ইত্যাদি।
উদ্যোক্তা সাবরিনা বলেন, ‘প্রযুক্তিতে সবসময় একটি সমস্যা সমাধান করার মানসিকতা থাকে, আমরা সমস্যাটি নির্ণয় করি তারপর মূল সমস্যাটি কীভাবে সমাধান করবো সেটা বের করি। সেই তথ্যের ভাণ্ডার ব্যবহার করেই স্কিন ইঙ্ক পণ্য প্রস্তুত করে থাকে’।
উদ্যোক্তা সাবরিনা নিজে বিনিয়োগের পাশাপাশি হংকং এবং কোরিয়ার বিনিয়োগকারীদের থেকেও তহবিল সংগ্রহ করে থাকে।
উদ্যোক্তা সাবরিনার এখন লক্ষ্য ফিটনেস স্টুডিও, সুস্থতা কেন্দ্র এবং ত্বকের যত্নে ভেন্ডিং মেশিন চালু করা। বর্তমানে কোম্পানির প্রতিটি দিকের বিকাশে বিভিন্ন মিটিং করতে হয় সাবরিনাকে। সরবরাহকারীদের সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা কৌশল সবকিছুতে তিনি যুক্ত হন।
এতো ব্যস্ততার মাঝেও তিনি প্রতিদিন সকালে জগিং করেন এবং রাতের বেলা পরিবারের জন্য সময় রাখেন। মাঝে মাঝে তার কর্মীদের নিয়েও আড্ডার আয়োজন করেন।
৪৫ বছর বয়সী এই নারী উদ্যোক্তা সাবরিনা ট্যান তার এই সফলতার পেছনে তার কারিগরি মানসিকতাকে প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেন।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)