ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করে ১৯৯৬ সালে খ্যাতনামা একটি বাইং হাউজে একাউন্টেন্ট হিসেবে যোগ দিলেন মোঃ তৌহিদুর রহমান। ১১ মাস চাকরি করবার পর একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি আর মানি এক্সচেঞ্জ সাথে প্রিন্টিং এর কিছু ব্যবসা করলেন। ব্যবসায় তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারলেন না তিনি। এরমাঝে বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হলেন। মায়ের মৃত্যুর পর পরিবারের সকল দায়িত্ব পড়লো তার উপর। প্রায় ৭ বছর কেটে গেলো, ২০০২ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকে জয়েন করলেন তিনি। সেই ব্যাংকে কাজ করতে করতে মন ভরছিলো না তার, যার মনে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন তার কি আর চাকরিতে মন ভরে? কি করা যায় ভাবতে লাগলেন, খুঁজতে খুঁজতে ব্যবসা পেয়েও গেলেন, চাকরি ছেড়ে দিলেন। যার সাথে পার্টনারশিপের ভরসায় চাকরি ছাড়লেন সে সরাসরি না করে দিলো, পায়ের তলার মাটি সরে গেলো তৌহিদের। শেয়ার মার্কেটে কিছু টাকা খাটানো ছিলো, ২০০৭ সালের দর পতনে তাতেও নামলো বিরাট ধস। ২০০৮ সাল, নিজের সঞ্চয় মাত্র ৭ লাখ টাকা দিয়ে কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন তৌহিদ।
বাবার ১০০০ স্কয়ার ফিটের একতলার বাসা ছেড়ে দিলেন। দুজন টেকনিক্যাল পার্টনার এবং একজন কর্মী, দুটি ম্যানুয়াল মেশিন নিয়ে আহম্মদবাগে বিস্কুটের ট্রে বানাবার এবং সাপ্লাই দেয়ার ফ্যাক্টরির যাত্রা শুরু করেন তৌহিদ। কিন্তু কাজ আসছিলো না। সে সময় ব্লিস্টার প্যাকেজিং , মোবাইলের ব্যাটারি, চার্জার, মাজুনির কাভার, যা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের তৈরি তা বানাতে শুরু করলেন তৌহিদ। হঠাৎ একটি অর্ডার মোড় ঘুরিয়ে দিলো, ইউনাইটেড এমিরেটস এর রাজ পরিবারের যে খাবার সেই খাবারের ডিস কাভার তৈরির কাজ। ১ লক্ষ পিস ঢাকনা, ১০ লক্ষ টাকার কাছাকাছি লাভ, আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেলো তৌহিদের। লালবাগ, কামরাঙ্গীর চরে ভাঁড়া নিলেন একটি জায়গা। সেখানে ছোট করে নতুন ফ্যাক্টরি, সাথে পেতে শুরু করলেন বিস্কুটের ট্রে তৈরির অর্ডার। মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ পিস। কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করলেন তৌহিদ। ১০ জন কর্মী নিয়ে নিয়মিত চললো মোল্ট বা ছাঁচ বানানোর গবেষণা যা যেকোনো কোম্পানির বিস্কুট ট্রে বা যেকোনো ডিজাইনের ট্রেই আসুক না কেনো সেটা বানাবার সক্ষমতা অর্জন করানো। ধীরে ধীরে কাজের অর্ডার এবং আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকলো।
২০১০ সাল, বাবা এবং ছোটভাই অর্থ নিয়ে এগিয়ে এলেন তৌহিদের ব্যবসায়ে। চায়না এবং ভারত থেকে আসলো নতুন মেশিন, ক্যাপাসিটি বাড়তে থাকলো, ১০ থেকে ১৫ লক্ষ পিস উৎপাদনে সক্ষম হলেন উদ্যোক্তা তৌহিদের প্রতিষ্ঠান ‘এফ এম প্লাস্টিক’। কর্মী সংখ্যাও বাড়তে থাকলো।
২০১৩ সালে একটি ভেঞ্চার কোম্পানির সাথে যোগাযোগ হয় উদ্যোক্তার। উদ্যোক্তার অবস্থান, ব্যবসার স্থিরতা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনার ওপর প্রথম বিনিয়োগ হয় উভয়পক্ষের। উদ্যোক্তার দক্ষতা এবং ব্যবসায় প্রশাসন দেখে বিনা জামানতে উদ্যোক্তাকে একটি মোটা অংকের টাকা ঋণ প্রদান করলো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিটি। ২০১৩ তেই আবার নতুন মেশিন বসালেন, উৎপাদন শুরু হলো গ্লাস এবং কাপের। ২০১৫ তে আবারো ব্যবসায়ে বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি এবার ইকুইটি ইনভেস্টমেন্টে আসলো উদ্যোক্তা তৌহিদের সাথে। নিজের কেনা জায়গায় প্রায় সোয়া একর জমির ওপর ৫৫ হাজার স্কয়ার ফিটে উদ্যোক্তার স্বপ্ন ‘এফ এম প্লাস্টিকের’ ফ্যাক্টরি গড়ে উঠে।
উৎপাদন ক্যাপাসিটি বেড়ে দাঁড়ায় ২০০ টন প্রতি মাসে যা পিস হিসেবে কয়েক কোটি পিসে উত্তীর্ণ হয়। প্রায় ২০০ প্রোডাক্ট লাইনে আজ ফ্যাক্টরি কাজ করছে। মাইক্রোওয়েভ, ওভেন হিটপ্রুফ প্রোডাক্ট এবং সহজে ছেঁড়ে না বা ফাটে না এমন পণ্যগুলো, মানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মানে উৎপাদন শুরু করলেন উদ্যোক্তা তৌহিদ।
রিসাইকেলবল প্রোডাক্ট নিয়ে আজ ব্যবসার ভুবনে নিজের পণ্য এবং অবস্থান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলছেন সফল উদ্যোক্তা মোঃ তৌহিদুর রহমান। ২০১৮ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত জাতীয় এসএমই মেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নিলেন বর্ষ সেরা মাঝারি উদ্যোক্তার পুরষ্কার।