ইন্টারন্যাশনাল এনজিও’র চাকরি ছেড়ে একজন সফল উদ্যোক্তা

0
উদ্যোক্তা নাহিদ সুলতানা

বরাবরই পোশাকে ভিন্নতা ছিল নাহিদ সুলতানার। প্রচলিত ফ্যাশনের বাইরে নিজস্ব পছন্দ এবং নিজস্ব ডিজাইনের ড্রেস পরতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। সে ক্ষেত্রে হ্যান্ডপেইন্ট পোশাকের প্রতি অন্যরকম আকর্ষণ ছিলো সবসময়। তাই অফিস কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে হ্যান্ডপেইন্ট শাড়ি বা পোশাক পরতেন। এমনকি ২০০৫ সালে নিজের গায়ে হলুদের শাড়িটিও ছিলো হ্যান্ডপেইন্টের। সহকর্মী বা পরিচিতজনরা বেশ পছন্দ করতেন তার পোশাক। অনেক সময় তারা আবদার করতেন তাদেরকে হ্যান্ডপেইন্টের পোশাক করে দেওয়ার জন্য। সেই থেকে তিনি উদ্যোগ নিলেন, তার পছন্দের পোশাকটি তিনি পৌঁছে দেবেন সবার কাছে।

ইডেন কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েই জুনিয়র অফিসার হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন নাহিদ সুলতানা। পোস্টিং ছিলো মুন্সীগঞ্জে। এক বছর পর চাকরি ছেড়ে ঢাকায় এসে আইসিএমএ-তে ভর্তি হন, একইসঙ্গে ফিনিক্স গ্রুপে চাকরি শুরু করেন। পরে ‘এডুকো’ নামে একটা ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে কাজ শুরু করেন।

চাকরির পাশাপাশি ‘জলরঙ’-এর সব কাজ নাহিদ সুলতানা নিজেই দেখাশোনা করতেন। ধীরে ধীরে কলেবর বাড়তে শুরু করে, পাশাপাশি চাকরির পজিশনটাও ছিলো বেশ দায়িত্বপূর্ণ। যে কারণে ২০১৯ সালের শুরুর দিক থেকে চাকরির পাশাপাশি ‘জলরঙ’ চালানো এবং এর কলেবর বাড়ানো তার জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। দিনে ২/৩ ঘন্টা ঘুমিয়ে সব দিক সামলে উঠতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন নাহিদ সুলতানা। অনেক চিন্তা ভাবনার পরে চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কেননা তার ‘জলরঙ’-এ যারা কাজ করছেন তাদের রুটিরুজির দায়িত্ব ছিল তার উপর। এছাড়া উদ্যোগটা ছিল তার নিজের, ছোট কিংবা বড় যাই হোক না কেন; এটা সম্পূর্ণই তার নিজস্ব। তাই ২০১৯ সাল থেকে শুধুমাত্র উদ্যোগ নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করেন।

নিজের উদ্যোগকে আরও সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে, নিজেকে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে এবং উদ্যোগ সম্পর্কে আরও জানতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কোর্স করেছেন তিনি। যেমন ফ্যাশন ডিজাইনের উপর ডিপ্লোমা, জুয়েলারি ডিজাইন নিয়েও তিনি ডিপ্লোমা করেছেন। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ডিপ্লোমার পাশাপাশি ই-কমার্স ও ফেসবুক বিজনেস নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। পাশাপাশি ২০ বছরের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তাকে এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করছে। মোট কথা নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্ভাব্য সব রকম চেষ্টাই তিনি করেছেন এবং এখনও করছেন।

এখন পর্যন্ত ‘জলরঙ’-এর মূল ফোকাস হ্যান্ডপেইন্টের পোশাক। হ্যান্ডপেইন্ট পোশাকের মূল বিশেষত্ব হচ্ছে এর নান্দনিকতা এবং অনন্যতা। একই ডিজাইন একই শিল্পী করলেও কখনোই ডিজাইনের কপি হবে না। তাই প্রতিটা পোশাক বা শাড়ি অনন্য এবং সিগনেচার কালেকশন। যারা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেখতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য মূলত হ্যান্ডপেইন্টের পোশাক একেবারে আদর্শ পছন্দ।

নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে উদ্যোক্তা নাহিদ সুলতানা বলেন, “শুরু থেকেই আমরা দেশীয় ফ্যাব্রিকের উপরে কাজ করছি। হ্যান্ডপেইন্টের মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী ফ্যাব্রিককে আমরা জনপ্রিয় করতে চাই। এর সুবিধাগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই। তাই শুরুতে রাজশাহী সিল্ক ও মসলিন শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্ট করার পরিকল্পনা করি। পরে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতেও। শাড়ির পাশাপাশি একে একে মসলিন ও সুতির থ্রি-পিস, ওড়না, ফতুয়া, কুর্তি প্রোডাক্ট লাইনে যোগ হয়। মোটকথা নারীদের পোশাকের সবগুলো ক্ষেত্রেই আমরা কাজ করছি।”

ঢাকার সাভারে ছোট একটা কারখানা আছে তার, সেখানে ৮ জন কর্মী নিয়ে ‘জলরঙ’-এর কাজ হচ্ছে। ব্যক্তিগত অর্ডারের মাধ্যমে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিতে তার পোশাক গেছে, যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই।

দীর্ঘ আলাপচারিতায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে উদ্যোক্তা বার্তাকে নাহিদ সুলতারা বলেন, “হ্যান্ডপেইন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে আবারও বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে চাই ভিন্ন আঙ্গিকে, পাশাপাশি অন্যান্য বাংলাদেশী ফ্যাব্রিকের উপর হ্যান্ডপেইন্টের নতুন নতুন ফিউশন আনতে চাই। প্রোডাক্ট রেঞ্জ ও ডিজাইন নিয়ে কাজ করে যেতে চাই বহুদূর। স্বপ্ন দেখি একদিন মানসম্মত বাংলাদেশি পোশাক আর ‘জলরঙ’ সমার্থক হবে।”

মায়ের কর্মসূত্রে নাহিদ সুলতানার জন্ম এবং বেড়ে উঠা পিরোজপুর জেলায়। মা ছিলেন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আর বাবা কলেজের অধ্যাপক। তার শৈশব ও কৈশোরের পুরোটাই কেটেছে পিরোজপুরে। শিক্ষাজীবন শুরু করেন পিরোজপুর সরকারি গার্লস স্কুলে। সেখান থেকে এসএসসি পাস করে সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন৷ পরে হিসাববিজ্ঞানে লেখাপড়া করেন ইডেন কলেজে। তিন ভাইবোনের মধ্যে নাহিদ সুলতানা সবার বড়।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here