নিজের থাকার ঘরটিকে সুন্দর ও পরিপাটি করে সাঁজিয়ে রাখতে কে না চায়! সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে নিজের থাকার ঘরটি সাঁজাতে চান। আবার অনেকে চিন্তা করেন কি দিয়ে ঘর সাঁজাবেন। কি দিয়ে সাঁজালে ভালো লাগবে। সুন্দর লাগার পাশাপাশি যাতে একটু চমকপ্রদ ও আধুনিকতার ছোঁয়া থাকে সেটাও অনেকে মাথায় রাখেন।
ঘর সাঁজানোর ক্ষেত্রে নিখুঁত কারুকার্যের পণ্যগুলো যেমন ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে। তেমনি ঘরের বাসিন্দাকেও সবার কাছে তুলে ধরবে একজন রুচিশীল মানুষ হিসেবে। আর এই ধারণাকে সামনে রেখেই কাজ শুরু করেন উদ্যোক্তা আফরোজা আক্তার।
পারিবারিকভাবে ব্যবসার দীক্ষা পাওয়া আপরোজা আক্তার জানালেন তার উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের গল্প। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন। তখন থেকেই হস্ত শিল্পের প্রতি একটি আকর্ষণ কাজ করতো তার। বংশগতভাবে বাবা ও দাদা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ছিলেন। বাবার ছোটখাটো একটি গার্মেন্টস ছিল যা দিয়ে পরিবার চলত। তখন থেকেই আফরোজার উদ্দেশ্য ছিল বাবার মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হবেন। একক ভাবে গড়ে তুলবেন একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। যেখানে অসহায় নারীরা ঘরে বসে কাজ করতে পারবে। সেই সঙ্গে শিক্ষিত হওয়ার পরও যে সকল নারীরা কিছু করতে পারছেন না, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবেন।
এমন নানা পরিকল্পনা নিয়ে আফরোজা গড়ে তোলেন ‘কালারফুল হোম ডেকর’ নামের একটি হস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে সরাসরি আফরোজার নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি হয় হ্যান্ডমেড -ফ্রিজ, মাইক্রোওভেন, নর্মাল ফ্রিজের হ্যান্ডেল কভার, টি সেট কভার, কুশন কভার, ডাইনিং চেয়ার-টেবিল কভার, টিভি কভার, গরম রুটির বাস্কেট কভার, টিস্যু বক্স কভারসহ বিভিন্ন ধরনের সুতা দিয়ে সব পণ্য। তার এই সব পণ্যকে সৃজনশীল উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চান এই উদ্যোক্তা।
২০০৬ সালে রাজধানীর ‘ওয়াইডব্লিউসিএ’ নামের একটি সংগঠন থেকে হস্তশিল্পের সমস্ত পণ্য তৈরির উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকেই মূলত আগ্রহ আরো বেশি বেড়ে যায়। এরপর সিদ্ধান্ত নিলেন উদ্যোক্তা হবেন।
২০১৩ সালে মাত্র ২০০ টাকা দিয়ে একটি স্যাম্পল তৈরি করেন। সেই পণ্যটি তার এক প্রতিবেশি কিনে নেন। এরপর সেই পণ্যটি নিয়ে যখন সেই প্রতিবেশীর বাসায় যান। তখন ওই প্রতিবেশীর একজন বান্ধবী উপস্থিত ছিলেন। তিনি স্যাম্পলটি দেখে খুব পছন্দ করেন। তার শোরুমের জন্য সাড়ে চার হাজার টাকার পণ্য কিনে নিলেন। শুরু হলো উদ্যোক্তা হিসেবে আফরোজার পথ চলা।
আফরোজা আক্তার বলেন, ‘২০০ টাকা দিয়ে যাত্রা শুরুর ৪ দিন পরে সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। মার্কেটে কি ভাবে পণ্য বিক্রি করা যায়। এই বিষয়ে ধারণা নিতে আমার ছোট খালার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে বলেন, প্রোডাক্টগুলো হোলসেল (পাইকারি) করতে পারিস। পরে আমার খালা “জয়িতা” নামক স্টলের প্ল্যাটফর্ম চালায় এমন এক বান্ধবীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। সেখানে তার একটি স্টল ছিল। যার নাম হল “পাতা আপা”-সবাই তাকে পাতা নামে ডাকত। তিনি ছিলেন “জয়িতা ফাউন্ডেশন” প্ল্যাটফর্মের পরিচালক। ‘জয়িতার’ পাতা আপার কাছে বিক্রি করা শুরু হলো আমার পণ্য। সে সময় আরো কয়েকজন ক্রেতার কাছ থেকেও পণ্যের অর্ডার পেলাম। “জয়িতা ফাউন্ডেশন প্লাটফরমে” আমার বিক্রি আরো বাড়তে শুরু করল।
“কালারফুল হোম ডেকর’ এর পরবর্তী যাত্রা নিয়ে আফরোজা বলেন, “জয়িতা প্লাটফর্মে “একজন নারীর সঙ্গে দেখা হল, যার নাম ছিল ‘মিনা আপা’। তিনি দুবাই প্রবাসী। সেখানে তার একটি শো-রুম আছে। মিনা আপার বোনেরও কানাডায় শো-রুম আছে। তাদের কাছেও পাইকারি দামে পণ্য বিক্রি করা শুরু করলাম। এইভাবে কিছুটা লাভবান হতে থাকলাম। বর্তমানে যে পরিমাণ বিক্রি হয় তা দিয়ে আমার প্রতিষ্ঠান খুব ভালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছি।
এতো দিন পর্যন্ত আফরোজার উৎপাদিত পণ্য পাইকারিভাবে বিক্রি করে আসলেও বান্ধবীর পরামর্শে শুরু করলেন খুচরা বিক্রি। বান্ধবীর পরামর্শ মেনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পেইজ খুলে শুরু করেন নিজের পণ্য নিজেই বিক্রি। এরপর শুরু হলো আরো একটি সফলতার গল্প।
আফরোজা বলেন, পেইজ দিয়ে আমার পণ্যের প্রচার শুরু করলাম। এতে বিক্রি বাড়তে শুরু করলো। কিন্তু এভাবে ব্যবসার শুরুতে কিছু সমস্যা হয়। যেহেতু নিজের বাড়িতে কাজ করাতাম। কোন কারখানা বা বিক্রয় কেন্দ্র ছিলো না। শুরুতে গার্মেন্টসের দুজন মেয়ে দিয়ে কাজ করালেও পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পরে আরো ১০ জন কর্মী নিয়োগ করলাম। পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পণ্যের প্রচারে জন্য কর্মীদের ফিল্ডে নামিয়ে দিলাম।
সফল এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম সব নারীই কাজ করুক। এখন পর্যন্ত সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করছি আশপাশের অসহায় নারী ও তাদের সন্তানদের স্কুলের পড়ার পাশাপাশি কাজ শিখাতে এবং ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে সামনে এগিয়ে নিতে। ‘আমাদের ঐতিহ্য অনেক দিনের, এসব ব্যবহার করে অন্যরা লাভবান হচ্ছিল। তরুণরা আবার এগিয়ে আসায় আমরা শুধু আর্থিকভাবেই লাভবান হইনি, আমাদের ঐতিহ্যও হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাচ্ছে বলে জানান নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করে যাওয়া এই নারী।
মেহনাজ খান
উদ্যোক্তা বার্তা ঢাকা