দেশসেরা জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত উদ্যোক্তা- সুলতানা নুরজাহান রোজী

১৯৯২ সাল, এইচ.এস.সি পড়ুয়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে গেল এক তরুণীর। বিয়ের পর প্রতিদিন একটা দৃশ্য দেখতেন। বাংলো বাড়িতে থাকা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে লাকড়ী কেটে নিয়ে যায় কিছু সংখ্যক নারী। এই দৃশ্য তরুণী দাঁড়িয়ে দেখেন আর ভাবেন, কী করে এই জীবন থেকে নারীদের জীবনকে আরও একটু ভিন্ন উন্নততর কর্মে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়।

একদিন ডেকে নিয়ে তাদের সকলকে জিজ্ঞেস করলেন ‘আমি যদি কিছু করি, তোমরা কী আমার সাথে থাকবে? করবে কাজ নিজেদের উন্নয়নের জন্য?” সবাই উত্তর দিল ‘আমাদের পুঁজি শুধু পরিশ্রম’ চারজন নারী এলেন। তাদের সাহস, মনোবল এবং ইচ্ছাশক্তি ইজ ইকুয়াল টু কর্ম।

সেদিনের সেই সদ্যবিবাহিত তরুণী সুলতানা নূরজাহান রোজির গল্পটা ভীষণ ভিন্ন। মাত্র দুই কেজি ময়দা নিয়ে বসলেন সুলতানা নূরজাহান রোজি । ৪ জন নারীকে নিয়ে প্রথম দিনই বানালেন পুলি পিঠা, নারকেলের পুলি। কেমন কাজ করতে পারবেন নারীরা সেই সক্ষমতা যাচাই করলেন সুলতানা নূরজাহান রোজি। ফলাফল -তারা পারবে।

প্রথম ধাপ উতরে যাওয়ার পর, ৫ কেজি ময়দা, ৫ কেজি চালের গুড়া, ৩ কেজি চিনি, নারিকেল মাসিক বাজার থেকে সাশ্রয় করে নূরজাহান বসলেন, বানালেন ২০০ পুলি, ছাঁচের পিঠা, গুড়ের পিঠা, ছোট ছোট প্যাকেট করে সুন্দর করে সেদিনের সেই পণ্যগুলো সাজালেন একজন প্রত্যয়ী নারী সুলতানা নূরজাহান রোজি। এবার শুরু হবে উদ্যোগ। পাশেই কুলগাঁও স্কুলে ৪জন নারীদের টিম পাঠালেন। কিন্তু টিম ব্যর্থ। প্রথম দিন কিছুই বিক্রি হলো না।

বিক্রি করতে পারলো না ৪ নারী কর্মী সংকোচে, লজ্জায় আড়ষ্ঠতায়, আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলেন না উদ্যোক্তার টিমের সদস্যরা। ফিরে আসবার পর সুলতানা নূরজাহান রোজি তাদেরকে বোঝালেন ধৈর্য্য ধরবার জন্য। ‘তুমি একটা কিছু করছো’ এই কথাটিই বারংবার বোঝালেন। পরদিন টিমের তিনজন এলেন। একজন এলেন না। তিনজন বিক্রি করলো ৯ প্যাকেট। ১জন স্কুল শিক্ষক কিনে নিলেন সেগুলো। ৩য় দিন ব্যাপারটা ছিলো একটু ভিন্ন। শুকনো পিঠার সাথে এবার সুলতানা নূর জাহান রোজি তৈরি করলেন ভেজা পুলি। ১৫ প্যাকেট বিক্রি হয়ে গেল।

উদ্যোক্তা তরুণীর মধ্যে হাসি ফোঁটে, চোখে প্রত্যয়। আগের দিন সংকোচের ভয়ে যে একজন পালিয়ে গিয়েছিল সেও ফিরে এলো আরেকজনকে নিয়ে। এরপর টানা দুই মাস সফলতার ইতিহাস গড়তে, লড়তে পুরো টিম নিয়ে কাজ করতে থাকলেন অবিরাম সুলতানা নূরজাহান রোজী। দুই মাসের মধ্যেই চক বাজারের ‘এ্যাবা’ নামের ১টি দোকান নিয়মিত অর্ডার নিতে থাকলো।বাসার তিন তলার ছাঁদে একটি রুম বানিয়ে ফেললেন টিম নিয়ে নিজের কাজ করবার জন্য।

অনার্স শেষ করার সাথে সাথে উদ্যোক্তা হবার পথে হাঁটা। জামালখান রোডে ফারহানা তে একটি কোর্স করলেন বেকারি এর ওপর। দুইটি ব্যাসিক কোর্স সম্পন্ন করলেন নুরজাহান রোজি। ৭ টি নতুন আইটেম যোগ হলো উদ্যোক্তা রোজির বেকারি ফাস্ট ফুড আইটেমে।যেকোনো পারিবারিক বড় উৎসবে শত শত পিস পিঠা,বেলা বিস্কুট,বাকরখানি, টোস্ট অর্ডার নিতেন উদ্যোক্তা নুরজাহান রোজি। ছেলের জন্মদিনে মাত্র দুই বছরে প্রথমে সকলকে জানালেন নিজের উদ্যোগের সম্পর্কে। একজন বউমা একজন উদ্যোক্তার স্বীকৃতি পেলেন। পারিবারিক স্বীকৃতি মেলার সাথে সাথে উৎসাহ মনোবল হল পাহাড় সমান। এগিয়ে চলেন দৃপ্ত পদচারণায় দৃঢ় প্রত্যয়ে নারী উদ্যোক্তা সুলতানা নুরজাহান রোজি।

ছাদের ওপরে ২০ স্ক্যায়ার ফিটকে বড় করা হয়।২ টি রুমের একটি ছোট্ট ফ্যাক্টরি হয়ে গেল উদ্যোক্তার উদ্যোগ। প্রথমে তন্দুর চুল্লি এবং বাংলা ওভেন বসালেন। নিউ ডিজাইনে করে নিলেন নুরজাহান তার চুল্লীগুলো। মারকি আইটেমে উদ্যোক্তা নতুন স্বপ্ন আঁকেন। একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে যোগ দিলেন উইমেন ইন্টারপ্রিনিউর এসোসিয়েশন এ।

ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিত্ব উদ্যোক্তা সংগঠক মনোয়ারা হাকিম আলির নেতৃত্বে উদ্যোক্তারা নিজেদের ভেঙ্গে গড়ে, সাজিয়ে নতুন পথে এগিয়ে যান অসীম সাহস নিয়ে।কাজের পরিধি বাড়তে থাকে।স্কিল বাড়ানোর জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্টের বেশ কিছু কোর্স করে ফেললেন। শ্রদ্ধেয় সিদ্দিকা কবির এবং রাহিমা সুলতানা রিতা, তাদের কাছে কোর্স সম্পন্ন করলেন নুরজাহান রোজি। বিদেশি বিশেষজ্ঞ এবং প্রশিক্ষক ও এসেছেন প্যাকেজিং, প্রসেসিং, হেলথ, ফুড সেফটি, ফুড কন্টামিনেশন সবকিছুর ওপর কোর্স করা হয়। উইমেন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এর পক্ষ থেকে।

বিজনেস মডিউল,কস্টিং, প্রাইসিং সবকিছুর ওপর সম্যক ধারনা পেলেন সুলতানা নুরজাহান রোজি। চলার পথ হলো শাণিত।উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে তার এম.বি.এ. সম্পন্ন করে ফেলেছেন। ‘৯৭ সালে ঘরোয়া উদ্যোগ থেকে বানিজ্যিক উদ্যোগে পরিণত হলো উদ্যোক্তার নতুন উদ্যোগ “তানজুর ফুড”। ২০০০ সালে লাইসেন্স নিয়ে বেকারি এর আইটেমে পদার্পণ করলেন উদ্যোক্তার প্রথম হাতেখড়ি বেলা টোস্ট দিয়ে।একে একে যুক্ত হলো চানাচুর, গার্লিক টোস্ট, বাটার বান, কেক, বন পাউরুটি, ড্রাই কেক, কুকিস।পাউন্ডে পাউন্ডে বিক্রি হতে থাকলো বেকারি আইটেম। পিস থেকে পিসে বাড়তে থাকে উদ্যোক্তার উৎপাদন।শত শত পিস থেকে হাজার পিসে।

২০০২ সাল,উদ্যোক্তার উদ্যোগের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। চিটাগাং “মেট্রো”।চিটাগাং মেট্রো ছাড়িয়ে দক্ষিণে পটিয়া ছাড়িয়ে কক্সবাজারের হাট-হাজারি থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত ৭ জন ডিলার, ৮টি উপজেলা । রাত ৩.৩০ টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত একটি শিফ্ট। ২য় শিফ্ট দুপুর ২ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত। অনেক কর্মীর কর্মসংস্থান হতে শুরু করলো এবং বাড়তে থাকে উৎপাদন। ৪জন নারীকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন একজন নারী উদ্যোক্তা। মাত্র ২০ স্কয়ার ফিটে কাজ শুরু করে আজ কাজ করছেন তিন হাজার স্কয়ার ফিটে। হয়েছেন সমাজের এবং দেশের একজন সফল উদ্যোক্তা। কর্মসংস্থান সৃস্টি করেছেন ২০০জন কর্মীর ২০১৬ সালে অর্জন করেন এস.এম.ই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বর্ষসেরা নারী উদ্যোক্তা সম্মাননা।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here