নানী এবং মায়ের হাতের কাঁথার অপূর্ব সেলাই এর কাজ ৫ম শ্রেণীতে পড়ুয়া একজন ছাত্রীকে খুব আকৃষ্ট করতো। ছোট্ট ছোট্ট পুরাতন কাপড়ে নকশা তুলতেন রুনা, হঠাৎ করেই তার মনে হল নতুন একটা কাঁথা বানাতে হবে।

মায়ের কাছ থেকে জমানো মাত্র ৫০০ টাকা, সেই ৫০০ টাকা নিয়ে নতুন কাপড় কিনে কাঁথা বানালেন রুনা বেগম। একটি নতুন কাঁথা একটি জীবনের সুতাকেও বদলে দেবে তা জানতেন না মোছাঃ রুনা বেগম, কিন্তু সেই ভালোবাসা কে ধারণ করে এক একটা সিঁড়ি বেয়ে এগিয়েছেন।

এলাকাতেই মানুষের কাঁথা সেলাই এর কাজের অর্ডারের একজন কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করলেন। ৩০০-৫০০ টাকা আসতো একটি কাঁথা সেলাই এর জন্য। ১৫ দিনেই একটি কাঁথা বানাতে পারতেন রুনা বেগম। প্রতি মাসে ৫০০-১০০০ টাকা জমাতে শুরু করলেন রুনা বেগম। একটু একটু করে ৪০ হাজার টাকা জমিয়ে ফেললেন দিন রাত কাজ করে।

কাঁথা সেলাইয়ের কাজে কর্মীগণ ব্যস্ত

উদ্যোক্তা বার্তা তার এই উদ্যোগের সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় মোছাঃ রুনা বেগম বলেন, “ছোটবেলা থেকে এই হাতে সেলাই করার কাজ, নকশাগুলো তৈরী করা, কাঁথা সেলাই করা, এসব কিছু খুব আকর্ষণ করতো এবং কাজ শেখার আগ্রহ এই আকর্ষণের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিলো আমার মাঝে। আমার নানী, মা, খালা, চাচী সকলে বসে যখন কাঁথা সেলাই করতেন তখন তাদের থেকে আমি কাঁথা সেলাইয়ের কাজ  শিখি আর মায়ের কাছে জমা রাখা ৫০০ টাকা দিয়ে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছিলাম।”

লাইট জ্বালিয়ে গভীর রাতে সেলাই এর কাজ করে যেতেন অবিশ্রান্ত। এর মাঝেই স্বামী মোঃ শফিকুল আলম ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেন। ৫ বছর বিছানায় অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। এ পুরো সময়টা কাঁথা সেলাই করে পরিবারের হাল ধরে রেখেছেন মোছাঃ রুনা বেগম।

উদ্যোক্তা এবং কর্মীদের কর্মব্যস্ততা

২০০৭ সাল, জমানো ৪০-৫০ হাজার টাকা নিয়ে নিজেই হলেন উৎপাদক। অর্থাৎ একজন কর্মী থেকে উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন রুনা। ৭ জন কর্মী কে কর্ম ভিত্তিক নিয়োগ দিলেন, ৭ টি কাঁথা উঠে আসলো এক মাসে। অনেক উদ্যমে এবং আত্মপ্রত্যয়ী হলেন রুনা বেগম। সংসারে সুখ আনতেই হবে, এবং তা আনবেন নিজের কর্ম দিয়ে, নিজের কাছ থেকেই।

অর্ডার বাড়তে শুরু করল, ঢাকা থেকে আসলো অর্ডার। প্রবর্তনা সম্মানিত জনাব শামিম সাহেব, প্রায় ৫০ বছর আগের লহরী কাঁথা কে তুলতে পারেন এই প্রতিযোগীতায় নিয়ে আসলেন রুনা বেগম কে। এবং এই প্রতিযোগীতায় প্রথম হলেন রুনা বেগম। নিজের মানসিকতা এবং মানসিক দৃঢ়তা ইস্পাতসম হলো।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ্য থেকে জাপানে ট্রেনিং এর জন্য মনোনীত হলেন রুনা বেগম। না, ট্রেনিং নেবার জন্য নয়, ট্রেনিং দেবার জন্য। নিজের এই আত্মবিশ্বাস এবং নিজের পাওয়া বৃত্তির টাকা তাও দেশে ফিরে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন রুনা বেগম। ভীষণ পরিশ্রমী হয়ে উঠলেন উদ্যোক্তা রুনা।

প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকালের ছবি

দেশে ফিরে আরও ১৫ জন কর্মী কে কাজ দিলেন, নিয়োগ দিলেন নিজের কাঁথা তৈরির কাজে। নকশী কাঁথা, নিজের পারদর্শীতা তাকে দিল এক আলাদা সম্মান।  কাঁথার ট্রেনিং দেবার জন্য এবার রুনা বেগম গেলেন নেপাল। ছয়টি দেশের কারুশিল্পীরা সেখানে ট্রেনিং নিলেন।

নেপালে একজন ট্রেইনার হলেন উদ্যোক্তা রুনা বেগম। বিসিক থেকে লহরী কাঁথার পুরষ্কার পেলেন উদ্যোক্তা। ২০ জন কর্মীকে নিয়ে মাসে প্রায় ৫০ টির মত কাঁথা তৈরি করতে শুরু করলেন মোছাঃ রুনা বেগম। নানান ডিজাইনের নানান কাঁথার অর্ডার আসতে শুরু করে তার কাছে। সেই সাথে চলতে থাকে চাঁপাই নবাব গঞ্জের আঞ্চলিক ঐতিহ্য সজনী এবং লহরী কাঁথার উপর বিশেষ কাজ।

উদ্যোক্তা রুনা বলেন, “মূলধন টা তেমন কিছু না। টাকা আসলে আবার চলে যায়। কিন্তু কাজ টা অনেক বড় একটা ব্যাপার।তাই টাকা টা তেমন কোন ব্যাপার না, কাজ টাকে মূল্য দিলে টাকা আসবেই। নিজের মেধা থাকতে হবে, একটা ডিজাইন দেখলে যেন সেই ডিজাইন মাথায় রাখতে পারেন, ডিজাইন দেখলেই যেন সেই কাজ টা সাথে সাথে করতে পারেন। এবং অবশ্যই ধৈর্য্য থাকতে  হবে।”

শাহবাগ জাদুঘরে চারুকলায়, শিল্পকলা একাডেমি  বাংলা একাডেমি বা বিসিক যে কোন বড় বড় মেলায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে থাকেন উদ্যোক্তা মোছাঃ রুনা বেগম। ক্ষুদ্র একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে জয় করতে থাকেন সেই সুদূর চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে ঢাকা এবং বিদেশের নানা অঞ্চলে নিজের সুনামে।

উদ্যোক্তা মোছাঃ রুনা বেগম

নিজের গ্রাম গোহালবাড়ি, গোফনাথপুর, টিকরামপুর তিনটি গ্রামে ৩৫ জন কর্মীকে নিয়মিত কাজ দিচ্ছেন রুনা বেগম। প্রতি মাসে ৬০-৭০ টির মত কাঁথা তৈরি করছেন আজ রুনা বেগম তার দক্ষ কর্মী বাহিনীকে নিয়ে।

জাপান, ভুটান, নেপাল তিনটি দেশ থেকে  নিয়মিত আসেন নকশী কাঁথার কর্মীরা  তরুণ উদ্যোক্তা এবং নিপুণ কারিগর মোছাঃ রুনা বেগমের কাছে। তার কাছ থেকে ট্রেনিং নিতে, শিখতে লহরী কাঁথা এবং নকশী কাঁথার নানান নান্দনিক কাজ।

তারুণ্যকে জয় করেছেন, জয় করেছেন দারিদ্র্যকে। এবং সেই সাথে একজন শিল্পীর সম্মানে নিজের আসন চিনিয়ে দিয়েছেন। আজ ৫ লক্ষ টাকা মূল্যমানের ব্যবসা পরিচালনা করছেন চাঁপাই নবাবগঞ্জের নিভৃত গ্রামের উদ্যোক্তা মোছাঃ রুনা বেগম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here