উদ্যোক্তা- পলি

রিপনের জন্ম রাজশাহীর কোর্ট স্টেশনের মোল্লা পাড়ায়। বাবা-মা এবং পুরো পরিবারের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন সেখানে। মাধ্যমিক দিয়েছেন কাশিয়াডাঙা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। তিনি যতই বড় হচ্ছিলেন ততটাই অনুভব করতে পারছিলেন তার নামের সঙ্গে এবং তার ছেলে হিসেবে সমাজে পরিচয়টার যেন কোন মিল নেই। বড় হওয়ার সঙ্গে তার কথাবার্তা, চলাফেরা, শরীরের গঠন সবকিছুই যেন পরিবর্তন হচ্ছিল।

সেগুলো শুধু তিনিই নন, চারপাশের মানুষজনের চোখে পড়ছিল। তখন তারা বিভিন্নভাবে রিপনকে নিয়ে হাসাহাসি এবং মজার পাত্র হিসেবে দেখত। এর পর উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য ভর্তি হলেন কোর্ট কলেজে। সেখানেও বন্ধুবান্ধব, কলেজ যাওয়ার পথে পাড়া প্রতিবেশি রিপনকে নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠত। যা একটা পর্যায়ে আর সহ্য করতে পারছিলেন না রিপন। এভাবেই তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন। এর কিছু দিন পর তিনি যখন বুঝলেন তিনি ছেলে স্বত্ত্বা নিয়ে জন্মাননি, তাই আর সবার মন রক্ষার্থে সেভাবে চলতে পারলেন না। হয়ে উঠলেন রিপন থেকে ‘পলি’।

উদ্যোক্তা- পলি

সন্তান যখন রিপন থেকে পলি হয়ে উঠল, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন তার বাবা মোঃ আরাবুল ইসলাম এবং মা জরিনা বেগম। পলিকে তারা বাসা থেকে বের করে দিলেন, কোথায় গেল, কি খাচ্ছে কোন খোঁজ নিলেন না বেশ কয়েক বছর। পলি তার কমিউনিটির বাকি সদস্যদের সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু মানুষের থেকে কাজ ছাড়া টাকা চেয়ে জীবন-যাপন করার পক্ষপাতী ছিলেন না পলি। তিনি বেশ কিছু বিদেশি প্রকল্পে কাজ করলেন। কিন্তু অন্যের অধিনে থাকতে তার মন চাইত না। তিনি ভাবতেন- আমি এমন কিছু করবো যাতে আমি তো আত্মনির্ভরশীল হবই, পাশাপাশি আমার কমিউনিটির যারা আছে এবং কমিউনিটির বাইরে সমাজে অবহেলিত লোকদের কাজ দেব।

এই মহৎ উদ্যোগ নিয়ে মাত্র ৮ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করলেন। কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বাছাই করলেন হাতে তৈরি শাড়ি এবং ওয়ান পিস, টু পিস অর্থাৎ বুটিক আইটেম।

ছোট বেলায় তিনি যখন দেখতেন তার মা, নানি, চাচি সেলাই করতেন এই বিষয়টা তাকে টানত। ভাবতেন আমিও যদি সেলাই করতে পারতাম। সেই ভাল লাগা থেকে টুকটাক সেলায় শিখেছিলেন। সেখান থেকেই ২০১৪-তে তৈরি হল ‘দিনের আলো হ্যান্ডিক্রাফটস’।

যেহেতু পুঁজি কম তাই প্রথমে শুধু শাড়ি দিয়ে কাজ শুরু করলেন এবং সৌভাগ্য বসত প্রথম তৈরি শাড়িগুলো চলে গেল দেশের বাইরে। ১৭ জন কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন পলি।এভাবে বেশ কয়েকবার তার পণ্যগুলো ভারতে গেলো। কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়লো। শাড়ির পাশাপাশি ওয়ান পিস, টুপিস, থ্রিপিসের কাজ শুরু করলেন। কাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অর্ডার এবং কর্মীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। শত বাধা পেরিয়ে সাহসের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পেলেন ‘জয়িতা’ পুরষ্কার। কাজের আগ্রহ যেন আরো বহুগুন বেড়ে গেল। পলির নামের সঙ্গে যুক্ত হলো জয়িতা পলি।

উচ্চ মাধ্যমিকের পর জয়িতা পলির পড়াশোনা থেমে যায়। তিনি বলেন, আমি যখন পড়াশোনা করতাম তখন সকল কাগজপত্র ছেলে হিসেবে করা ছিল। যার কারণে এখন কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছিনা। তবে আমি অনেক আগেই আবেদন করে রেখেছি কাগজপত্র পরিবর্তনের জন্য। দুর্ভাগ্যবশত তা এতদিনেও পরিবর্তন হয়নি। যার কারণে আমি তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা শুরু করতে পারছিনা।

দেশের অনেক জেলায় জয়িতা পলির দিনের আলো হ্যান্ডিক্রাফটস’র পণ্য পৌঁছে গেছে এবং যাচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতেও তার পণ্য পৌঁছাচ্ছে। কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই যিনি কাজ শুরু করেছিলেন, শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছাকে কেন্দ্র করে। রাতের পর রাত জেগে নতুন নতুন নকশা তৈরি করতেন। পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতেন তার তৈরি পোশাকে। এভাবে কাজ করতে করতে তিনি অভিজ্ঞতা বাড়ালেন কাজের। প্রশিক্ষণ ছাড়া কাজ শুরু করা পলি এখন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সমাজ সেবা অধিদপ্তরে, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে।

তিনি কাজের পরিধি বৃদ্ধির জন্য অনেক জায়গায় ঋণের আবেদন করেছেন। কিন্তু লিঙ্গ বৈষম্যের জন্য সেখানেও বাধা। কোন জায়গা থেকেই এখনো ঋণ পাননি। তবে তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে থেমে যাননি। মনে জোর নিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন। ১৭ জন কর্মীর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন ৪৫০ জন।

২০১৭ তে পেয়েছেন জয়িতা পুরষ্কার। ২০১৮ তে জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কৃত হন বৃটিশ কাউন্সিল থেকে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ২০২১ এ মনোনিত হয়েছেন। মহামারী করোনার জন্য দেশের বাইরে পুরষ্কার গ্রহণ করতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। করোনার সময় তিনি মানবিক যোদ্ধা পুরষ্কার লাভ করেছেন। কাজের মাধ্যমে ৮ হাজার পুঁজি আজ ২০ লাখের বেশি হয়েছে।একটা সময় নিজ বাড়িতে যার জায়গা হয়নি, সে বাবা-মা আজ পলিকে নিয়ে গর্ব করে। যে প্রতিবেশীরা একটা সময় হাসিঠাট্টা করত, আজ তারা জয়িতা পলিকে সম্মান করে।

তরুণদের উদ্দেশ্যে পলি বলেন, ‘চলার পথে যে কত ধরনের বাধা আসে তা নিশ্চই তোমরা আমার জীবনের গল্প শুনে বুঝতে পেরেছ। আমি কিন্তু বাধা সামনে আসলে থেমে যাইনি। বরং আরো সাহস নিয়ে সামনে এগিয়েছি। যার কারণে আজ আমি রাজশাহীর গর্ব, বাংলাদেশের গর্ব, বিশ্বের গর্ব। তোমরাও পারবে। সাহস নিয়ে এগিয়ে যাও সফলতা তোমাদের দুয়ারে এসে হাতছানি দেবে’।

তামান্না ইমাম
রাজশাহী ডেস্ক, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here