ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছিলো বাংলার ঐতিহ্য কাঁসা শিল্প। তবে তরুণ এবং নবীন উদ্যোক্তাদের চেষ্টায় বাংলার হারানো এই ঐতিহ্যকে আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।
বর্তমানে কাঁসা পণ্যের বেশিরভাগই শৌখিন পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কেটলি, জগ, মগ, গ্লাস, শোপিস, ডিনারসেট, বিভিন্ন মূর্তি, ফুলদানি, রান্নার তৈজসপত্র থেকে শুরু করে সব ধরনের জিনিস পাওয়া যায়।
একটা সময় দিন-রাত পালা করে কর্মব্যস্ততায় বিভোর থাকতো কাঁসা-পিতল শিল্পীরা। দূর থেকে কান পাতলে শোনা যেতো তাদের হাতুড়ির টুংটাং ধ্বনি। তবে দিন দিন কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আধুনিক পণ্য বাজার দখল করায় ধ্বংসের মুখে শিল্পটি। কিন্তু অনেকেই আবার পুরনো পেশায় আসছেন। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কাঁসাশিল্প।
এক সময় বিয়ে কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র দেওয়ার রেওয়াজ ছিলো। দারুণ নকশার দৈনন্দিন ব্যবহার্য এসব জিনিসপত্র টেকসই, মজবুত ও দামে কম হওয়ায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এর কমবেশি ব্যবহার দেখা যেতো। কালের বিবর্তনে এর ব্যবহার কমে গেলেও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই এখনও এসব সামগ্রী ব্যবহার করছেন।
পুরান ঢাকার শাখারিবাজারে চোখে পড়বে কাঁসা পিতলের দোকান, সংখ্যায় কম হলেও ধীরে ধীরে এর চাহিদা বাড়ছে সেই সাথে জিনজিরা নদীর ধারে বাঁশপট্টিতে কারখানায় গিয়ে দেখা গেল কারীগরদের ব্যস্ততা। বিগত কয়েক মাস দেশের পরিস্থিতি খারাপ থাকায় একেবারেই ছিলো না, সে কারণে কিছু কারখানা এখনো বন্ধ দেখা যায় তবে আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে এই কারখানাগুলো৷ কর্মচারীদের হাতুরির টুংটাং শব্দে আবারও ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন তারা।
কথা হলো কারিগর আজিজুল ইসলামের সাথে। তিনি প্রায় ৩২ বছর ধরে কাঁসা-পিতল থেকে তৈরি করছেন বিভিন্ন নকশার বাসন। কাজের চাপ কম থাকলেও একেবারে বন্ধ করে দেননি।
তিনি বলেন, কাচামালের অধিক দাম এবং সহজলভ্য তৈজসপত্র ব্যবহারের কারণে ঐতিহ্যবাহী এ সকল কাঁসা পিতল আজ হারিয়ে যেতে বসেছে৷ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং নবীন উদ্যোক্তাদের হাত ধরে কাঁসা শিল্পকে আবারো ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
উল্লেখ্য, ১৫৭৬ -১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসনামলে এ দেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। এসব ধাতু দিয়ে তারা ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বন্দুক ও কামান তৈরি করত। ব্রিটিশ শাসনামলে এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এ শিল্পের ছোট-বড় বহু কারখানা গড়ে ওঠে।
নৃবিজ্ঞানীদের তথ্যসূত্রে জানা যায়, এ শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সে সময়ের রাজা প্রদ্যুৎ কুমার ঠাকুর। তিনি প্রথম এই হস্তশিল্পের সামগ্রী নিজে ব্যবহার করেন এবং বিভিন্ন রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে লন্ডনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এ স্বর্ণোজ্জ্বল রাজকীয় নকশার ডিনার সেট উপঢৌকন হিসেবে রাজপরিবারে পাঠিয়েছিলেন।
১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সে প্রদর্শনীতে জামালপুরের ইসলামপুরের কাঁসার বাসন দর্শকের বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে শিল্পী জগৎচন্দ্র কর্মকার তাঁর হাতে গড়া তৈজসপত্রের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ কাঁসাশিল্পী হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এতে করে সারা বিশ্বে কাঁসাশিল্পের পরিচিতি লাভ করে এর চাহিদা দিন দিন আরও বেড়ে যায়।
দেশে কাঁসাশিল্পের অঞ্চল হিসেবে খ্যাত ধামরাই, শিমুলিয়া, টাঙ্গাইলের কাগমারী, বগুড়ার শিববাড়ী, রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও জামালপুরের ইসলামপুর৷
একটা সময় শুধু মাত্র সাপ্তাহিক হাটে বাজার কিংবা বড় বড় দোকান গুলোতে কাঁসা পিতলের তৈজসপত্র দেখা যেত তবে এখন কেউ চাইলেই অনলাইনে অর্ডার করেও অতি দ্রত হাতের কাছে কাঁসার নান্দনিক সব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। কাঁসা শিল্পকে পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন গনসচেতনতা এবং কাঁচামালের সহজলভ্যতা। এই বিষয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা