বাগের হাটের মেয়ে সুলতানা পপি। বাবা ঢাকাতে কর্মজীবনে থাকাকালীন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা আসলেন। বাবা পপি আর বড় বোন মিলে ঢাকায় থাকতেন। বাবার কাছ থেকে প্রতিদিন বাজারের টাকা নিতে ভীষণ কষ্ট হতো পপির। পপি যোগ দিলেন ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর ফিল্ড সুপারভাইজার হিসেবে একটি কাজে। অনেক কিছু শিখলেন পপি সেই সময়টিতে। নারীরা অনেক নির্যাতিত হয়, তাদেরকে অনেক পিছিয়ে রাখা হয়। এটা দেখলেন পপি ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে। পপির মনে অনেক নাড়া দিয়ে যায় ব্যাপারটি। কাজে ভীষণ ভালো করলেন পপি।
থাইল্যান্ডে একটি স্কলারশিপের জন্য নাম আসলো তার। কিন্তু ঐ যে সামাজিক বাঁধা! টাকার যোগাড় হলোনা। পরিবারের মানসিক টানাপোড়েন পপিকে একটি স্কলারশিপে বিদেশ যেতে দিলো না। ইউনিভার্সিটি উইমেন্স ফেডারেশনে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হলেন সুলতানা পপি।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে মামা আনোয়ারুল ইসলাম ছিলেন। তিনি নানান বই মেলায় কাজ দিতেন। সেখানে বইয়ের নানান মেলায় সেলসম্যানশিপ এর পাশাপাশি নিজস্ব তৈরি রাবারব্যান্ট ভীষণ আনন্দের সাথে বিক্রি করতেন পপি।
পাঁচ বছর কাজ করলেন আড়ং এ একজন বিক্রয় কর্মী হিসেবে। সেসময় পপি নানান পণ্যের প্রস্তুতকারকদের তৈরি পণ্য দেখে ভীষণ উৎসাহিত হন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে করতে যুব-উন্নয়ন অধিদপ্তরে ব্লক এবং বাটিকের ট্রেনিং করলেন পপি। নিজে শিখে ভাবলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন শেখাবেন। চাকরির পাশাপাশি অফিস থেকে ফিরে একজন দুজন করে শিখতে শুরু করলো পপির কাছে।
২০০৪-২০০৫ সাল। ধীরে ধীরে পরিসর বাড়তে থাকে। মিরপুর হোপ স্কুলের পাশে একটি কমার্শিয়াল স্পেস নিলেন সুলতানা পপি। অনেক সাড়া মিললো।
১৯৯৬-২০০৬ সাল পর্যন্ত ব্যাক্তিগত উদ্যোগে নিজে হাতে কলমে বিভিন্ন পাঁচতারা হোটেলের প্রথিতযশা ব্যাক্তিত্ব শেফ বেকারী এক্সপার্ট এবং নানান বিখ্যাত খাদ্য প্রতিষ্ঠানের নামকরা ব্যাক্তিদের কাছে হাতে কলমে কোর্স করলেন পপি।
মিরপুরের কমার্শিয়াল স্পেসটিতে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে আইটেম শেখান পপি।প্রথম প্রথম সেলাই, ব্লক, বাটিক, রান্না, বেকারী, ফাস্টফুড, মোঘলাই ডিস এমন কয়েকটি কোর্স দিয়ে শুরু হলো। দুর্দান্ত ক্ষীপ্ত গতিতে শেখা এবং শিখে নিজে প্রস্তুত হয়ে শেখানো এটাই মূল শক্তি হয়ে মূলমন্ত্র হয়ে উঠলো পপির জীবনে।
মিরপুর ১০ ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, বিআরটিএ, হারম্যান মেইনার স্কুল এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় শতাধিক স্কুল ও কোচিং সেন্টার। স্কুল ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা মূল কাস্টমার এবং শিক্ষার্থী হলেন। সন্তানদের স্কুলে দিয়ে শতশত অভিভাবক শিখতে শুরু করলেন পপির একাডেমীতে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ট্রেনিং নিতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা, বাড়তে থাকে কোর্স। আজ হস্তশিল্পে ৫২ টি ক্যাটেগরি, দেশীয় রান্নায় ৬ টি, দেশীয় সবজি ৭টি, মাছের ভর্তা ৪ টি, ওভেন কুকিং এ ৩ টি, কুকিং এ ৭ টি এমন হাজারো আইটেমে হাজারেরও বেশি কোর্সে ট্রেনিং দিচ্ছেন উদ্যোক্তা ট্রেনার সুলতানা পপি তার একাডেমীতে।
প্রতিবছর ১৫০০ থেকে ২০০০ প্রশিক্ষণার্থী বিভিন্ন কোর্স করে বের হতে থাকলেন। কেউ কেউ কোর্স করেন বিয়ে-শাদী করে পরিবারকে একটু ভালো আর নতুন নতুন আইটেম রান্না করে খাওয়াবেন বলে। আর কেউবা কঠোর মনোবল নিয়ে কোর্স করেন উদ্যোক্তা হবার জন্য। এ পর্যন্ত করানো কোর্স থেকে প্রায় ২০ শতাংশ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। প্রশিক্ষনার্থীদের মধ্য থেকে হয়েছেন আত্মনির্ভরশীল। গড়েছেন কর্মসংস্থান।
একজন ট্রেইনার হিসেবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, এসএমই ফাউন্ডেশন, ফেভিকল পিডি লাইট, ট্রান্সকম, সিঙ্গার, এসওএস শিশু পল্লী, যুবপল্লী, এসওএস মাদার্স ট্রেনিং সেন্টারে নিয়মিত ট্রেনিং দিয়ে ট্রেনার হিসেবে কাজ করছেন সুলতানা পপি। এসিড সার্ভাইভার্স ফাউন্ডেশন এবং বিআর মেন্টর হিসেবে দিচ্ছেন ট্রেনিং। সব মিলিয়ে ৫০ হাজার শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়েছেন উদ্যোক্তা ট্রেইনার সুলতানা পপি। বেশ কয়টি জাতীয় দৈনিকে সাপ্তাহিকভাবে ছাপা হতে থাকলো উদ্যোক্তার রেসিপি। সেই সাথে দেশের জনপ্রিয় স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল দেশ টিভিতে ২০০৭ থেকে করে আসছেন নিয়মিত দূরপাঠ। সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে করেছেন নানান ট্রেনিং এ আত্মকর্মে বলীয়ান হতে। হয়েছেন একজন টেলিভিশন সেলিব্রিটি।
প্রথম অফিস নেন পপি, তখন মাত্র তিনজন কর্মী ছিলো। আজ তা রংধনু একাডেমীতে অফিস ম্যানেজমেন্ট এবং ট্রেনিং এ নিয়মিত টিমে ১০ জন কাজ করছে।
২০১৬ সালে সফল আত্মকর্মী হিসেবে পেলেন জাতীয় পুরষ্কার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। কোন মূলধন ছাড়াই শুরু করেছেন। ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী মানসিক বলে বলীয়ান সুলতানা পপি আজ সফলতার সাথে একজন উদ্যোক্তা, একজন ট্রেইনার হিসেবে পরিচালনা করছেন স্বীয় উদ্যোগ ব্যবসা ৫০ লক্ষ টাকা মূল্যমানের।
অপু মাহফুজ