উদ্যোক্তা নাফিহা নওরীন

দশ বছরের কর্মজীবন ভালোই চলছিলো। নিজের দক্ষতায় ছাত্রজীবন থেকেই স্বাবলম্বী ছিলেন। তবে বিয়ের পর সন্তানের মা হয়েছেন, সন্তানকে মানুষ করতে হবে। তাই চাকরি ছেড়ে দিতে হলো। তখন থেকে আবার কিছু করার চিন্তা করছিলেন। চাকরি করতে হলে তো বাহিরে যেতে হবে। কিন্তু কার কাছে রেখে যাবেন আদরের সন্তানকে। তবে থেমে থাকেন নি তিনি। ছোটবেলায় মায়ের কাছে থেকে শেখা শাড়ির আঁচলে ডিজাইনের কাজ শুরু করলেন। চাকরিজীবি নারী থেকে হয়ে গেলেন উদ্যোক্তা। বলছি সফল নারী উদ্যোক্তা নাফিহা নওরীন এর কথা। যিনি সখিতা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। মাত্র ৪৫০ টাকা নিয়ে যার পথ চলা। তার প্রতিষ্ঠানের মূলধন এখন অর্ধ কোটি টাকারও বেশি। নাফিহা নওরীন উদ্যোক্তা বার্তাকে শুনিয়েছেন সফলতার গল্প।

উদ্যেক্তা নাফিহা নওরীন জানালেন তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরির ১০ বছরের ক্যারিয়ার ছেড়ে দিতে হয়েছে সন্তানকে সময় দেয়ার জন্য। টাংগাইলের সুনামধন্য পরিবারে জন্ম হলেও শৈশব থেকে বড় হয়েছেন ঢাকায়। প্রবাসী বাবার সন্তান ও রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠা। তিনি শিক্ষা জীবন থেকেই নিজের হাত খরচের ব্যবস্থা করতেন টাংগাইলের শাড়িতে হাতের কাজের ছোঁয়ায়। মা ও খালার হাত ধরে সেলাইয়ে হাতে খড়ি তার, পাশাপাশি আঁকাআকি ছিলো শখের একটি অংশ।

শিক্ষা ও কর্ম জীবনেও সফল উদ্যোক্তা বলেন, ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালের দিকে যখন পড়াশোনার পাশাপাশি সাড়ে তিনশো টাকায় কেনা একটা শাড়ি হাতের কাজের করে এক হাজার টাকায় বিক্রি করতাম তখন ভাবতাম এই কাজ নিয়েই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবো। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের পড়ালেখা ও ভালো চাকরি পাওয়ায় উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেনি। তবে সমস্যার শুরু হয় সংসার জীবনে এসে। বিয়ের পরে যখন তার প্রথম সন্তান এলো তখন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাকে মানুষ করার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন। পরিবার, সন্তান আর সংসারের ব্যস্ততার ভিড়ে নিজে হারিয়ে খুঁজতে ছিলাম।

তবে কিছু করার তারণাটা টের পেতাম যখন কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনরা টিপ্পনী কেটে বলতেন, এতো মেধা, এতো পড়াশোনা করেও কি লাভ হলো? চাকরি ছেড়ে ঘরেই তো বসে আছেন। এ জন্যই মেয়েদের এতো বেশি লেখাপড়ার দরকার নেই। তা কোনো কাজে লাগে না।

তিনি আরো বলেন, আমি সব সময় চাইতাম নিজের অল্প করে হলেও আয়ের পথ থাকুক। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ঘুরে দাঁড়ানোর। সিদ্ধান্ত নিলাম যারা আমার মতো শিক্ষিত বেকার গৃহিণী। যারা সংসারে সারাদিন কাজ করলেও তাদের কাজের কোনো মূল্যায়ন করা হয় না, যে পর্যন্ত না সে টাকা উপার্জন করে। তাই সংসারে থেকেই এমন কাজ করতে হবে যা দিয়ে অল্প হলেও আয় হবে। পরিবারের সদস্যদের সম্মতি ও সহযোগিতায় ২০১৫ সালের মার্চ মাসে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম ‘সখিতার’। সখিতার অর্থ হলো- সখ্যতা বা বন্ধুত্ব। আমি চাই বন্ধুত্বের হাত ধরে একে অপরের সহযোগিতায় কাজ করে যাবে সখিতা। এই লক্ষ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে সখিতার।

উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার স্বামীর মাধ্যমে একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বৈশাখের গিফট হ্যাম্পার তৈরি করার কাজ পেলাম। কাজ টি পাওয়ার শর্ত ছিলো আগে কাজের একটি স্যাম্পল দেখাতে হবে। সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে স্যাম্পল রেডি করে দেখালাম। কাজ দেখে পছন্দ হওয়া আমি অর্ডার পেলাম। প্রথম অর্ডার থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি উদ্যোক্তা নাফিহা নওরীনের। ১৫ হাজার দিয়ে পথ চলা প্রতিষ্ঠানটির এখন মূলধন ৫০ লাখ টাকারও বেশি।

তিনি বলেন, ব্যবসা শুরুতে কিছু স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ব্যবসা করার পাশাপাশি ঘরে ঘরে একজন করে ক্ষুদ্র উদ্দ্যোক্তা তৈরি করা চাই। আমি চাই নারীরা অন্তত নিজে স্বাবলম্বী হোক। আমার প্রথম টার্গেট দেশের শিক্ষিত গৃহিণী নারীদের নিয়ে কাজ করা। যারা নানা কারণে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্বেও নিজের আয়ের ব্যবস্থা করতে পারছে না। আমার পরের লক্ষ হলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কাজ করা। তাদের ছোটখাটো হাত খরচের জন্য পরিবারের কাছে হাত পাততেই হয়। যেহেতু তারা স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়, তাই তাদের নিয়ে কাজ করার কারণ হচ্ছে, তারা চাইলেই ঘরে বসে পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিদিন কাজের ফাঁকে ২-৩ ঘন্টা সময় দিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের হাতখরচের টাকা আয় করতে পারবে। আর এই প্রতিযোগীতার যুগে কিছুটা ইউনিক ও মানসম্মত পণ্য নিয়ে কাজ করলে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা সহজ হয়।

বর্তমানে নিজস্ব ডিজাইন ও মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে সখিতার দুটি অংশের কার্যক্রম চলছে । যার একটি হচ্ছে প্রডাকশন ইউনিট, যেখানে কাস্টমাইজড বুটিক ডিজাইনের পোশাক তৈরি হচ্ছে। যেগুলো লিমিটেড কালেকশন হিসেবে তৈরি করা হয় পাইকারি বিক্রির জন্য। আর যেহেতু এগুলো সখিতার নিজস্ব ডিজাইনার কালেকশন, বাজারে চলমান সহজলভ্য ডিজানের থেকে আলাদা, তাই এই পোশাক যে কেউ চালে আমাদের কাছ থেকে পাইকারি কিনে নিয়ে ঘরে বসে খুব সহজেই অনলাইনে বিক্রি করতে পারছেন।

সখিতার মাধ্যমে বর্তমানে সফল উদ্যোক্তা বেকারত্ব ঘোচাতে কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শতাধিক গৃহিণী, ছাত্র-ছাত্রীরা ঘরে বসে আয় করছে। এছাড়া সখিতার হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ ইউনিটও নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করে চলছে। ক্র্যাফটি সখিতা ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে দেশের গন্ডি পেরিয়ে পাশের দেশ ভারত থেকেও অনেক শিক্ষার্থী এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছে। দেশের স্বনামধন্য প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে এখানে বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া দেশে প্রথমবারের মতো লুম বিডিং গহনা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রচলিত বিষয়ের বাইরে গিয়ে নতুন শিল্প নিয়ে কাজ করার উৎসাহ ও সহযোগিতা করার পাশাপাশি প্রায় হারিয়ে যাওয়া দেশিয় শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। প্রশিক্ষণের আওতায় এনে দক্ষ কর্মী তৈরি করার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে এই উদ্যোক্তা নাফিহা নওরীনের এই প্রতিষ্ঠান।

উদ্যোক্তা নাফিহা নওরীন বিশ্বাস করেন, একজন দক্ষকর্মীই হতে পারে ভবিষ্যতের দক্ষ উদ্যোক্তা। এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়েছে। আবার অনেকেদেশের বাহির থেকে অর্ডার এনে কাজ করছেন। অনেকে নিজের মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে সখিতায় কার করার সুযোগ পাচ্ছেন।

সখিতার সুনাম এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের বাজারে পৌঁছে গেছে জানিয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন,
২০১৭ সালে বসুন্ধরা কনভেনশন হলে এক সপ্তাহ ব্যাপি মেলায় অংশগ্রহণ করে বেশ ভালো পরিচিতি পেয়েছি। পরের বছর জাতীয় যাদুঘরের মিলনায়তনে পাঁচ দিন ব্যাপি বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণ করে সখিতার পরিচিতি আরো বেড়ে যায়। এরপর ২০১৯ সালে উত্তরা ও মিরপুর ডি.ও.এইচ.এস এ মেলায় অংশগ্রহণ করার পর ভারতের কোলকাতায় মেলা করার প্রস্তাব আসে। সেখানে অংশ নিয়ে সাতদিন ব্যাপি মেলায় নিজের দেশীয় পণ্য গর্বের সঙ্গে বিক্রি করি এবং মেলায় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেস্ট সেলার হয় সখিতা।

সখিতার বাজার নিয়ে তিনি বলেন, সখিতার পণ্য বর্তমানে ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তবে বর্তমান সরকার নতুন উদ্যোক্তাদের, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অনেক সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছে। আশাকরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অচিরেই সখিতার পণ্য বিশ্বের বাজারে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে দেশের অর্থনীতিতে ভুমিকা রাখতে পারবে। এছাড়া সখিতা একদিন ক্ষুদ্র শিল্প থেকে মাঝারি শিল্পতে নিয়ে যেতে পারবে।

তিনি বলেন, সব সময় নিজেকে ক্ষুদ্র উদ্দ্যোক্তা তৈরির উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চেয়েছি। বলা যায় উদ্যেক্তা আমি নাফিহা নওরীন, হতে চাই উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোক্তা।

নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে সফল এই নারী বলেন, উদ্যোক্তা হতে চাইলে আগে আগে দক্ষ কর্মী হন। একজন দক্ষকর্মী হতে হলে নিজের কাজের বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস থাকতেই হবে। পাশাপাশি ধৈর্য আর পরিশ্রম দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নিজে কাজ না জানলে অন্যকে পরিচালিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই আপনি নিজে যখন একজন দক্ষকর্মী হিসেবে তৈরি হবেন তখনই নিজেকে দক্ষ উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। এই কাজে অনেক সময় লাগবে এমন অজুহাতে নিজের স্বপ্ন পূরণের কাজ বন্ধ করবেন না। আপনি কাজ না করলেও সময় ঠিকই চলে যাবে।

মেহনাজ খান
উদ্যোক্তা বার্তা ঢাকা

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here