সোনালি আঁশের উদ্যোক্তার চোখে সোনালি স্বপ্ন

0
উদ্যোক্তা আবদুল খালেদ

পাটজাত পণ্য সব সময়ই পরিবেশবান্ধব। চট-বস্তা ছাড়াও তৈরি হচ্ছে চোখ ধাঁধানো শোপিস, চেয়ার, জুতা, ফুলদানি, কুশন-কভার, সালোয়ার-কামিজ, পাপোশ ও চাদরের মতো পণ্য। এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য যেমন সৌন্দর্যবর্ধক তেমনি শতভাগ পরিবেশবান্ধব এবং দামও সাধ্যের মধ্যে। বর্তমানে এসবের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বিশ্ববাজারের ক্রেতাদের। ফলে নিঃসন্দেহে এই শিল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

দেশে আরও অনেকের মতো পাট ও পাটজাত পণ্য শিল্পকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখছেন ‘কারুকাজ জুট প্রোডাক্টস’ এর স্বত্ত্বাধিকারী আবদুল খালেদ।

তার বেড়ে উঠা ঢাকার শান্তিনগরে। পড়াশোনাও করেছেন ঢাকাতে। বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন এবং মা গৃহিণী। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম এবং ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। শিক্ষা জীবনে কমার্স গ্র্যাজুয়েট হিসেবে পড়াশোনা শেষ করেই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।

সেসময় অনেক স্বপ্ন হাতছানি দিয়েছে। কখনও বিদেশের হাতছানি, কখনও মনে হয়েছে সামর্থ্য-বিবেচনায় চাকরিই ভালো, আবার কখনও চারপাশের শৈল্পিক কর্মকাণ্ড অর্থাৎ দেশীয় নানান হস্তশিল্প মনকে উদ্বেলিত করতো। তার মনে হতো এসব তো নিজেও পারবেন, আর তাই তিনি একটু একটু বুনে চলেন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। হাতের তৈরি তালের পাখা, সুপারির খোলের পাখির বাসা, ঘাসের তৈরি কতশত হস্তশিল্প, কাপড়ের পুতুল, মাটির খেলনাপাতি– এমন শত শত হস্তশিল্প দিনে দিনে খালেদকে একজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে স্বপ্ন দেখাতো।

এসব স্বপ্ন দেখার মাঝেই খালেদ গড়ে তুললেন ডিজাইন হাউস ও প্রিন্টিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠান “সৃজন”। দুই বছর পর বন্ধ করে ১৯৯৪ সালে নতুন করে প্রকাশ পেলো ‘কারুকাজ’, যা পরে গ্রুপ আকারে কাজের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে কারুকাজ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড মার্কেটিং এইড, কারুকাজ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস, কারুকাজ ইন্টেরিয়র অ্যান্ড এক্সটেরিয়র সল্যুশন এবং কারুকাজ জুট প্রডাক্টস।

এই চারটি কাজে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ করা তার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে। তার সকল ধ্যান-জ্ঞান সব কিছুই পাটের শিল্পায়নকে ঘিরে।

আবদুল খালেদ বলেন, “সফলতার সাথে পথ চলা আমার ভেতরে সামাজিক দায়িত্ববোধের জন্ম দিয়েছে। মনে হয় কাজের পাশাপাশি যুগোপযোগী ও টেকসই নতুন উদ্যোক্তা তৈরি আমাদেরই নৈতিক দায়। এই চিন্তা থেকে আমি টেকসই উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করে চলেছি।”

উদ্যোক্তা খালেদ ২০১৯ সাল থেকে ৫৩০ জন টেকসই উদ্যোক্তাকে উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং বর্তমানেও তা চলমান আছে। এছাড়া বিগত বছরগুলোতে অগণিত ক্লাস্টার ট্রেনিং করিয়েছেন কাঁচামাল তৈরির ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাতে। পাশাপাশি পাটজাত পণ্য ও নতুন নতুন পাটের ভ্যালু-অ্যাডেড এক্সসরিজ তৈরিতে, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে একটা রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন, যাতে সকল উদ্যোক্তার সহায়তায় কাজে লাগে এবং দেশের পণ্যমানের উন্নয়ন হয়।

নিজের উদ্যোগে আবদুল খালেদ বেশ অনেক ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যেমন পাটের লেডিস ব্যাগ, পাপোশ, জুতা, পেন্সিল ব্যাগ, বাজারের ব্যাগ, টাওয়েল, পর্দা, পাট এবং বানানা ফাইবার ব্যাগ, জেন্টস অফিস ব্যাগ, কুশন কাভার, ফুলদানি, পেন্সিল হোল্ডার ইত্যাদি। তার কারুকাজ জুট প্রোডাক্টস প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে পুরনো ক্যাটাগরির পণ্য ছাড়াও ১০টি নতুন ক্যাটাগরির পণ্য উৎপাদন করে থাকে।

রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি জানান, তার স্বপ্নের কারুকাজ জুট প্রডাক্টস পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলছে। “সরাসরি মামুদপুর, ফতুল্লায় অবস্থিত ফ্যাক্টরি পরিচালনার মাধ্যমে পাটজাত পণ্য বেশ কিছু দেশে রপ্তানি করছি। এর মধ্যে কানাডা, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, মিডলইষ্ট, মালয়েশিয়া, জাপান উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি স্থানীয় বিপণনে কর্পোরেট সেলে আমরা এদেশের লিডিং প্রতিষ্ঠানের একটা। এছাড়াও নিজস্ব সেলস্ আউটলেট পরিচালনার মাধ্যমে আমরা সারাদেশে খুচরা ও পাইকারি পাট ও পাটজাত পণ্য বিক্রি করে দেশব্যাপী আজ সফল ও সমাদৃত।”

সফলতা অবশ্য সহজ ছিল না। প্রতিটি ধাপে সমন্বয়হীনতা, অসহযোগিতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকায় জীবনের প্রতিটি ধাপে যখনই আটকে গেছেন তখনই নতুন করে শিক্ষা গ্রহণ করে এগিয়ে গেছেন। তার মতে, বর্তমানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ভালোই– তবে আরও স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আশা করেন তিনি।

খালেদ বলেন, “বিশ্ববাজারে দিনকে দিন পাটজাত পণ্যের যে চাহিদা পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে উদ্যোক্তাদের নিজেরাই এগিয়ে আসতে পারেন। পাশাপাশি সরকারকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কারিগরি, আর্থিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিয়ে যেতে হবে।”

তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি খালেদের পরামর্শ: সকল আগ্রহী উদ্যোক্তাদের বলি মনোবল হারাবেন না, পথ যতো মসৃণ হবে ততো বেশি শেখাটা কম হবে। তাই কঠিন পথ পাড়ি দিতে প্রস্তত হন। তবেই একজন টেকসই সফল উদ্যোক্তার স্বাদ পাবেন। পুঁজি নয়; আচরণ, মানবিক গুণাবলি আর অভিজ্ঞতা আপনাকে সামনে এগোনোর পথ দেখাবে।

ভবিষ্যতে ‘কারুকাজ’ ব্র্যান্ডের পণ্য দেশব্যাপী আগ্রহী উদ্যোক্তাদের নিয়ে ফ্রাঞ্চাইজি আউটলেট পরিচালনা করতে চান বলেও জানান আবদুল খালেদ।

মেহনাজ খান,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here